মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন
২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান ‘ক্রিসমাস’। এই অনুষ্ঠানের বয়স দু'হাজার বছর ছাড়িয়েছে। যুগে যুগে সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক নানা উপায়ে উৎযাপন করা হয়েছে ক্রিসমাসকে।
খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারক হিসেবে খ্যাত যীশুখ্রিস্টের জন্মবার্ষিকীতে প্রতি বছর এ অনুষ্ঠান পালন করেন ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা। তবে, এদিন যীশু ধরায় এসেছেন এ বিষয়ে কোন স্পষ্ট প্রমাণ নেই। সে আলোচনা আরো বড়। এ দিনে তাদের আয়োজিত জনপ্রিয় আচার অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে উপহার বিনিময়, ক্রিসমাস ট্রি সাজানো, গীর্জায় সমাবেশ, পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে একত্রে ভোজনবিলাস। শিশুরা অপেক্ষা করে কখন স্যান্টাক্লজ আসবেন, তাদের উপহার দিয়ে যাবেন।
আমাদের দেশে বহু আগে থেকেই এ দিনটি সরকারি ছুটির দিন। যুক্তরাষ্ট্রে ১৮৭০ সাল থেকে ২৫ ডিসেম্বর ক্রিসমাস ডে কে রাষ্ট্রীয় ছুটির দিন হিশাবে পালন করা হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে ক্রিসমাস অনুষ্ঠানের সময় থাকে শীতের মাঝামাঝিতে। মজার ব্যপার হলো, যীশু আবির্ভাবের বহু আগে থেকেই বিশ্বজুড়ে এসময়ে নানা উৎসবের আয়োজন হতো।
যীশু জন্মের শত শত বছর পূর্বে ইউরোপিয়ানরা ক্ষীণ দিনের আলোয় এ সময়ে 'প্রভা ও জন্ম' ( লাইট এন্ড বার্থ) উৎসব পালন করতো। শীতের সবচেয়ে কঠিন সময় পেছনে ফেলে এসে শীতকালের মাঝামাঝিতে এসে মানুষজন আনন্দ উন্মাদনায় গাঁ ভাসিয়ে দিতো আর অপেক্ষা করতো গ্রীষ্মের। অধিক সূর্য কিরণ ও উষ্ণতার আগমনী বার্তা শীত জর্জরিত সেই প্রাচীন মানুষদের শরীরে শিহরণ বইয়ে দিতো। স্ক্যান্ডিনেভিয়ার নর্স সম্প্রদায় ডিসেম্বরের একুশ তারিখ থেকে শুরু করতো ইয়ুল উৎসবের। গ্রীষ্মের আগমনকে সামনে রেখে ছেলেবুড়ো নির্বিশেষে সব পুরুষ মানুষ বেরিয়ে পড়তো বড় বড় গাছের গুড়ি জোগাড় করতে। সেসব গাছের গুড়িতে আগুন জ্বালিয়ে তার চারপাশে চলতো ভোজন উৎসব, যতক্ষণ না কাঠগুলো পুড়ে শেষ হচ্ছে। এ উৎসব শেষ হতে সময় লাগতো ১২ দিনের মতো। খ্রিস্টানদের বিশ্বাস ছিলো অদ্ভূত। তারা মনে করতো তাদের উৎসবের অগ্নিকুণ্ডলীর প্রতিটি আলোক কণা নতুন বছরে জন্মানো একটি শুকর বা গরুকে নির্দেশ করতো, যেগুলো তাদের শিকারে পরিণত হতে যাচ্ছে!
ডিসেম্বরের শেষভাগ ছিলো ইউরোপে উৎসবের আবহের জন্য আদর্শ। কারণ এ সময়ে সব গবাদিপশুকে জবাই দেয়া হতো, যাতে ওগুলোকে সারা শীত বসিয়ে বসিয়ে না খাওয়াতে হয়।পাশাপাশি সারা বছর ধরে গ্যাঁজানো মদ এ সময়ে এসেই পানের উপযুক্ত হতো। জার্মানির আধিবাসীরা মধ্যশীতের সময়টাতে দেবতা ওডেনের উপাসনা উৎসব আয়োজন করতো। জার্মানরা দেবতা ওডেনকে খুব বেশি ভয় করতেন, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিলো এই দেবতা রাতের বেলায় উড়ে বেরিয়ে মানুষদের পর্যবেক্ষণ করেন ও সিদ্ধান্ত নেন কারা উন্নতি করবে ও কারা ধ্বংস হবে। তার ভয়ে মানুষরা সচরাচর বাইরে বের হতো না। অন্যদিকে প্রাচীন রোমে কিন্তু শীতের তীব্রতা স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও জার্মানির মতো এতোটা তীব্র ছিলো না মোটেই। তবু তারা শীতের এ সময়টাতে প্রাচীণ রোমের কৃষিকাজের দেবতা স্যাটার্ন এর উপাসনা উৎসবের আয়োজন করতো। তারা এ উৎসবের নাম দিয়েছিলো স্যাটারনালিয়া। এটি এমন সময়ে আয়োজিত হতো যখন চারদিক খাদ্য ও পানীয়ের প্রাচুর্যে ভরপুর থাকতো। এ উৎসবের এক মাস রোমের সমাজ ব্যবস্থাটাই পুরোপুরি উলটে যেতো। প্রজারা তখন থাকতো রাজার ভূমিকায় আর রাজা হতেন প্রজা, হালচাষীরা হতেন জমিদার। সকলে যাতে উৎসবে সমানভাবে অংশ নিতে পারে সেজন্যে বন্ধ রাখা হতো বিদ্যালয় ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো।
কাছাকাছি সময়েই অনুষ্ঠিত হতো প্রাচীন রোমের অন্যতম বিখ্যাত উৎসব 'জুভেনালিয়া'। এটি ছিলো রোমের সকল শিশুদের সম্মানে আয়োজিত উৎসব। এছাড়া এসময় রোমের উচ্চবিত্ত পরিবারগুলোর অনেকেই প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের ২৫ তারিখ সূর্যের দেবতা মিথ্রার উপাসনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন। মিথ্রাকে একজন শিশু দেবতা হিসেবে গন্য করা হতো, তার জন্ম পাথরখণ্ড থেকে হয়েছে বলেও বিশ্বাস করতো অনেকে। অনেক রোমানদের জন্য মিথ্রার জন্মদিন ছিলো বছরের পবিত্রতম দিন। খ্রিস্টান ধর্ম প্রসারের শুরুর দিকে ইস্টার সানডে ছিলো এ ধর্মের সবচেয়ে পবিত্র দিবস। যীশুর জন্মদিন পালনের কোনো রেওয়াজই তখন প্রচলিত ছিলো না। খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গীর্জার কর্তাব্যক্তিরা প্রভু যীশুর জন্মদিনকে ছুটির দিন হিশাবে প্রতিষ্ঠিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। অবাক করার বিষয় হলো, বর্তমানে সহজলভ্য বাইবেলে যীশুর জন্মতারিখ সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ পাওয়া যায় না। যদিও কিছু কিছু সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে জানা যায়, তাঁর জন্ম হয়েছিলো বসন্তের মধ্যভাগে। তারপরও পোপ প্রথম জুলিয়াস যীশুর জন্মদিন হিশাবে শীতকালের এ সময়টিকেই নির্ধারণ করেন। অনেকেই তখন সন্দেহ করতেন, রোমান মূর্তি পূজাকারীদের স্যাটারনালিয়া উৎসবের সঙ্গে মিল রেখেই সুকৌশলে এ দিনটি ঠিক করা হয়েছিলো। যীশুর জন্মোৎসব নামে খ্যাত এ রীতি ৪৩২ খ্রিস্টাব্দে মিশরে ও ষষ্ঠ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডে ছড়িয়ে পড়ে। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় এ উৎসব জনপ্রিয় হয় অষ্টম শতকে।
বর্তমানে গ্রীস ও রাশিয়ার সনাতন গীর্জাগুলোতে ২৫ ডিসেম্বরের ১৩ দিন পরে ক্রিসমাসের আয়োজন করা হয়, যা এপিফানি অথবা থ্রি কিংস ডে নামেও খ্যাত। বিশ্বাস করা হয়, এদিনটিতেই তিনজন বিজ্ঞ লোক যীশুকে গামলার মধ্যে থেকে উদ্ধার করেন। অন্যান্য ইউরোপীয় উৎসবের সময়েই খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা ক্রিসমাস পালনের সিদ্ধান্ত নেন, কারণ তাদের কৌশল ছিলো এতে করে ক্রিসমাস উৎসবটি সকলের মধ্যে জনপ্রিয়তা পাবে। মধ্যযুগে এসে ইউরোপের অধিকাংশ পৌত্তলিক ধর্মানুসারীরা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে। আজকের দিনের মারডি গ্রাসের মতো তখনকার দিনের খ্রিস্টানরা মদ্যপ হয়ে কারনিভালের মতো করে ক্রিসমাস উদযাপন করতো। প্রতি বছর একজন ভিক্ষুক ও একজন ছাত্রকে কুশাসনের রাজা হিসেবে ঘোষণা করতো ও উন্মত্ত উৎসবমুখর জনতা হতো তার প্রজা। দরিদ্র রাজাটি তখন শহরের ধনী ব্যক্তিদের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের বাসায় থাকা উৎকৃষ্ট খাবার ও পানীয় দাবি করতেন। যদি ধনীরা তা না দিতে পারতেন, গরিব রাজার অনুসারীরা তাদের নানাভাবে ভীত সন্ত্রস্ত করার চেষ্টা করতো। ক্রিসমাসের সময় প্রত্যেক ধনী পরিবারকেই সমাজের নিচু শ্রেণীর প্রতি তাদের অদৃশ্য 'ঋণ' শোধ করতে হতো।
সপ্তদশ শতাব্দীতে ধর্মীয় প্রথা সংস্কার আন্দোলনের হাওয়া ইউরোপজুড়ে ক্রিসমাস আয়োজনের ঢং পরিবর্তন করে দিলো। ১৬৪৫ সালে যখন অলিভার করমওয়েল ও তার পিউরিট্যান বাহিনী ইংল্যান্ড দখল করে, তারা ইংল্যান্ডকে তখন অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় এবং তারই এক অংশ হিশাবে ক্রিসমাসকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। তবে, দ্বিতীয় চার্লসের সিংহাসনে আসীন হবার পরপরই এ জনপ্রিয় রীতিটি আবার ইংল্যান্ডে প্রত্যাবর্তন করে। ১৬২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে আগমনকারী ইংল্যান্ডের বিচ্ছিন্নতাবাদী পিলগ্রিমরা ছিলো করমওয়েলের থেকেও বেশি রক্ষণশীল। যার কারণে যুক্তরাষ্ট্র শুরুর দিকে উৎসব হিশাবে পালনের রেওয়াজ ছিলো না। বরঞ্চ, ১৬৫৯ থেকে ১৬৮১ সাল পর্যন্ত বোস্টনে ক্রিসমাস ছিলো রীতিমতো নিষিদ্ধ! যদি কারো মধ্যে এর সমর্থনে কিছু করার লক্ষণ দেখা যেতো, তাকে ৫ শিলিং জরিমানা করা হতো। যাই হোক, জেমস্টাউন বন্দোবস্তের মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্রেও ক্রিসমাস জায়গা করে নেয়।
কিন্তু মার্কিন রিভোলিউশনের পর পুরো যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইংলিশ রীতিনীতি ছুঁড়ে ফেলার হিড়িক পড়ে। এগুলোর মধ্যে ক্রিসমাসও অন্তর্ভুক্ত ছিলো। সত্যি কথা বলতে, যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিসমাসকে সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা করা হয় অনেক পরে, ১৮৭০ সালের ২৬ জুন। মার্কিনরা ঊনবিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত ক্রিসমাসকে সাদরে গ্রহণ করেননি। ইউরোপে যেভাবে বিশৃঙ্খল উপায়ে ক্রিসমাস উদযাপন করা হতো, মার্কিনরা তার আমূল পরিবর্তন আনেন। তারা এ দিনটি পরিবারের সঙ্গে আনন্দ আয়োজন ও স্মৃতি রোমান্থনের মাধ্যমে কাটানোর রেওয়াজ চালু করেন। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকটা ছিলো শ্রেণী কলহ এবং বিক্ষোভ আন্দোলনের সময়। বেকারত্বের হার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিলো। ক্রিসমাসের সময় সর্বহারা দলগুলো দাঙ্গা বাঁধিয়ে দিতো প্রতিনিয়ত। এমনকি ১৮২৮ সালে নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম পুলিশ বাহিনীও গড়ে তোলা হয় ক্রিসমাসকে ঘিরে দাঙ্গা ঠেকাতে। এসময় নিউইয়র্ক এর ধনিকশ্রেণীর কিছু ব্যক্তি ক্রিসমাস আয়োজনে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেন।
১৮১৯ সালে কিংবদন্তী লেখক ওয়াশিংটন আরভিং 'দ্য স্কেচবুক অফ জোফ্রে ক্রেয়ন' নামের একটি গল্পের সিরিজ লিখেন। গল্পগুলো ছিলো একটি খাদ ইংরেজ পরিবারে তার কাটানো ক্রিসমাসের অভিজ্ঞতা নিয়ে। তার এ বইটি আমেরিকায় ক্রিসমাসের উদযাপন পরিবর্তনে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। ক্রিসমাস উদযাপনে প্রথিতযশা লেখক চারলস ডিকেন্সের 'দ্য ক্রিসমাস ক্যারল' বইটির ভূমিকাও উল্লেখযোগ্য। এ বইটির মাধ্যমে ডিকেন্স দেখান যে, ধনী গরিবের ভেদাভেদ ভোলার জন্য একটি বড়সড় ধর্মীয় ছুটির দিন কতটা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রে ও ইংল্যান্ডে ডিকেন্সের এ মতবাদ বেশ প্রভাব ফেলে। এভাবেই প্রগতিশীলদের অবদানের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিসমাস অনুষ্ঠান আজকের জনপ্রিয়তার পর্যায়ে পৌঁছায়। একটি উঠতি জাতি হিশাবে ক্রিসমাস হয়ে আসে মার্কিনদের আনন্দের উপলক্ষ।
যীশু কখনো কোথাও দাবি করেননি, আমি প্রভু। তিনি একমাত্র মহান প্রভুর কাছেই মাথা নত করেছেন এবং তাঁরই প্রার্থনা করেছেন।
হ্যাপি ক্রিসমাস।
লেখকঃ মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন, মহেশখালীর সন্তান ও পুলিশ কর্মকর্তা