মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন
আগের দিনই জাতীয় পরিষদের পূর্ব নির্ধারিত সভা স্থগিত করাকে কেন্দ্র করে ঢাকায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। বঙ্গবন্ধু এক তারিখেই ঘোষনা দিয়ে রেখেছিলেন দুই তারিখ থেকে পাঁচ তারিখ হরতাল পালন করা হবে।
এদিন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতাল পালন শুরু করেছে। হরতালে যুক্ত হয়ে গেলেন শ্রমিক, ছাত্র, শিক্ষকসহ সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ। দিনের দৈর্ঘ্য বাড়ার সাথে হরতালের উত্তাপও বাড়াতেছিল। হঠাৎ করেই ঢাকার পরিবেশ দিক ঘুরিয়ে নতুন মোড় নিতে শুরু করল। সব শ্রেণি- পেশার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে হরতালের পরিধি বাড়িয়ে দিল, মিছিল নিয়ে রাস্তায় নামেন সবাই। ঢাকার মাটি প্রকম্পিত হতে সময় লাগল না। অঘোষিতভাবে এক অনিবার্যতার দিকেই যেন যাচ্ছিল ঢাকার রাজপথ। মানুষের শরীরি ভাষা বলে দিচ্ছিল তারা নির্দেশ চায়। হায়ানার দল সুযোগের অপেক্ষায় ছিল। পুরো জাতি অধীর আগ্রহভরে অপেক্ষায় থাকে জাতির জনকের নির্দেশের। দিনের মধ্যভাগে মিছিল আর সমাবেশ সূর্যের উত্তাপ ছেড়ে যায়। মানুষ মুক্তি চায়। রাজপথ প্রকম্পিত করা আর স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনা যে এক বিষয় নয় সেটা ভালভাবেই জানতেন জাতির পিতা। তিনি জাতিকে আরো সংগঠিত করার অপেক্ষায় ছিলেন। সাতকোটি মানুষকে এক করা খুব সহজ কাজ ছিল না। দূরদর্শী জাতির পিতা অসাধ্য সাধনের সে দিকেই যাচ্ছিলেন।
নিরস্ত্র সাধারন মানুষের এমন অংশগ্রহণ ছিল আশা জাগানিয়া। তাদের পুঁজি ছিল কেবল জাতির পিতার আহ্বান আর তাদের মনের আবেগ। কোন প্রকার প্রশিক্ষণ ছাড়া আমাদের আম জনতাকে একটি সু-সংগঠিত ও প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক যুদ্ধে নামিয়ে দেওয়া একজন বীরের পক্ষে অসমীচীন ছিল। স্বাধীনতার মহানায়কের দূরদর্শিতা অনেকেই বুঝতে পারেননি। যুদ্ধ ঘোষনাকে অনেকেই তখন অনিবার্য হিসেবে নিলেও বঙ্গবন্ধু সময় নিলেন। তিনি জানতেন কখন কী করতে হবে।
জাতির মুক্তিদাতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর সহকর্মীরা পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছিলেন আর জনগণের আশা-আকাঙ্খার বাস্তবায়নের উপায় খুঁজছিলেন। জনগণ স্বাধীনতার আকাঙ্খা সেই সময় ব্যাপকভাবে রাস্তায় নেমে আসতে থাকে। কিন্তু মানুষকে সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত না করে নেতার পক্ষে স্বাধীনতার ডাক দেওয়ার পরিণতি জাতিকে হঠকারিতামূলক বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত করতে পারে। তাই জনগণকে আরো প্রস্তুত করার অবস্থানে ছিলেন বাঙালী জাতির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
মানুষের মিছিলে মিছিলে প্রকম্পিত হতে লাগলো রাজপথ। বঙ্গের পলিমাটি ধারণ করল কঠিন ও রুদ্ররূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড়ো হতে লাগল শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ। জমায়েত হওয়ার কোন প্রকার আহ্বান ছাড়াই লক্ষ লক্ষ ছাত্র জনতা জড়ো হয়ে বিশাল সমাবেশে পরিণত করল। এ মানুষ মুক্তি চায়। মহানায়কের একটি বাক্যই এদেরকে উত্তাল সমুদ্র বানিয়ে দিতে পারে। যে সমুদ্রের গভীর জলে নিমিষেই ভেসে যাবে হানাদার বাহিনীর সব দম্ভ। তিনি অটল। তাঁর দূরদর্শিতা অতুলনীয়। তিনি সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করবেন না। তাঁর মহাকাব্যিক ভাষণই সব কিছুর জবাব দেয়।
এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার সমাবেশে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ, আব্দুল কুদ্দুছ মাখন, নুরে আলম ছিদ্দিকীসহ অন্যান্যদের সাথে নিয়ে ডাকসু ভিপি আ স ম আবদুর রব স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের অনিবার্যতাকে ত্বরান্বিত করলেন। স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলনের মধ্যদিয়ে সামরিক-রাজনৈতিক-বেসামরিক পরিকল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ পায়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংসদ স্থগিতের সিদ্ধান্ত না মানার ঘোষণা দিয়ে ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে গণ জমায়েতের আহ্বান জানান। ঢাকায় হরতাল পালিত হয় পূর্ব ঘোষণা অনুসারে। এদিনের খারাপ দৃষ্টান্ত হলো, ঢাকা বিমানবন্দরে সামরিক বাহিনীর প্রবেশকে বাধা দেওয়ার সময় সেনাবাহিনীর গুলিতে দু'জন নিহত হন। অপরদিকে সামরিক জান্তা সংবাদপত্রের উপর বিধি-নিষেধ আরোপ করে নতুন আরেক আদেশ জারি করে এদিন। এদি সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি জান্তারা। কারফিউ ভেঙে বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জনে মুখরিত হতে থাকে ঢাকার রাজপথ। চলতে থাকে বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ, গুলিবর্ষণ। এদিন ঘোষণা আসল, পল্টনে জনসভা ও গণমিছিলের, ভাষণ দেবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ আসে। জাতির জনক ঘোষণা করলেন,
- ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন।
- ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। এই দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিশেবে পালন করতে হবে।
- রেডিও, টেলিভশন ও সংবাদপত্রে আমাদের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা নাকচ করে দিতে হবে।
- আগামী ৭ই মার্চ বিকাল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণসমাবেশে ভাষণদান করবো। সেখানে আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করবো।
- সংগ্রাম সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে চালাতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে এবং গণবিরোধী শক্তি ও তাদের ভাড়াটিয়া চরদেরই স্বার্থোদ্ধার করবে।
স্বাধীনতার লাল সূর্যের দিকে আরেকটি দিন এগিয়ে গেল অদম্য জাতি।