Advertisement


মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্পে ৫২ হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে কেন?


বিবিসি।।
বাংলাদেশের মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র শিগগিরই পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করতে যাচ্ছে। জাপানের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় নির্মিত বাংলাদেশের একটি আলোচিত মেগা প্রকল্প এটি।

এক হাজার দুইশ মেগাওয়াট ক্ষমতার এ বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশে যতগুলো কয়লা-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে তার মধ্যে সবচেয়ে ব্যয়বহুল।

এই বিদ্যুৎ প্রকল্পে খরচ হচ্ছে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা। মাতারবাড়ী প্রকল্প নিয়ে অনেকেরই জিজ্ঞাসা হলো প্রকল্পটি কেন এত ব্যয়বহুল।

মাতারবাড়ী প্রকল্পটি নির্মাণে চুক্তি হয় ২০১৪ সালে। এর কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে। শুরুতে মাতারবাড়ী প্রকল্পের ব্যায় ধরা হয় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২১ সালে এ প্রকল্প সংশোধন করে সময় বৃদ্ধি করা হয়। তখন ব্যয় বাড়ে আরো ১৬ হাজার কোটি টাকা।

বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার দিক থেকে মাতারবাড়ী প্রকল্পের খরচ তুলনামূলক অনেক বেশি। সমসাময়িক আরেকটি প্রকল্প বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা ১৩২০ মেগাওয়াট।

এই প্রকল্পে খরচ ১৬ হাজার কোটি টাকা। পটুয়াখালীর পায়রা বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিও ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার। পায়রা প্রকল্পের নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো।

সেদিক থেকে হিসেব করলে মাতারবাড়ী প্রকল্পটি পায়রা প্রকল্পের আড়াইগুন এবং রামপালের থেকে তিনগুন বেশি ব্যায়বহুল।

অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আন্তর্জাতিক মাপকাঠি অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রকল্পগুলো 'অতিমূল্যায়িত' বলেই বিবেচিত হয়।

“যে সমস্ত বিদেশি অর্থপুষ্ট প্রকল্প হচ্ছে তার সবগুলোই প্রায় অতিমূল্যায়িত বলে আমাদের কাছে মনে হয়," বলেন মি. ভট্টাচার্য।

তিনি মনে করেন, শুধু মাতারবাড়ী প্রকল্প নয়, বাংলাদেশে যে কোন প্রকল্পের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মাপকাঠির তুলনায় বেশি ব্যয় নির্ধারণ করা হয়।
পটুয়াখালীর পায়রা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র

মাতারবাড়ী প্রকল্পে জাপানের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা বা জাইকা অর্থায়ন করেছে এবং এ প্রকল্পে জাপানি প্রযুক্তি এবং সহায়তা নেয়া হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, মাতারবাড়ী প্রকল্পে বিনিয়োগের ধরন এবং এর বাস্তবায়নে বিলম্ব হবার কারণে নির্মাণ খরচ বাড়াতে বড় ভূমিকা রেখেছে।

প্রকল্পের অর্থায়নের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, হচ্ছে তাদের কাছ থেকেই যদি অর্থ নেয়া হয় তখন তাদের কাছ থেকে নানা শর্ত আরোপ করা হয় এবং তাতে ব্যয় বেড়ে যায়।

"শর্ত থাকার কারণে আপনি প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে অনেক সময় অনেক ধরনের প্রযু্ক্তি সুবিধা বা সেবা আপনি কিনতে পারেন না। আরেকটা বড় অঙ্ক এটার সাথে থাকে সেটা হলো বিদেশ বিশেষজ্ঞদের জন্য বরাদ্দ। এটাও মাতারবাড়ির জন্য প্রযোজ্য," বলেন মি. ভট্টাচার্য।

প্রকল্প পরিচালকের যুক্তি
কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলায় ১৬শ একর জমিতে গড়ে উঠেছে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ প্রকল্প। এ বিদ্যুৎ প্রকল্পে দুটি ইউনিট প্রতিটি ৬শ মেগাওয়াট ক্ষমতার।

এ প্রকল্পের কয়লা পরিবহনের জন্য আলাদা জেটি নির্মাণ এবং ১৮.৫ মিটার গভীরতার ১৪.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩৫০ মিটার প্রস্থের একটি নৌ চ্যানেল তৈরি করা হয়েছে।
মাতারবাড়ি প্রকল্পে বন্দর ও চ্যানেল নির্মাণে খরচ হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা।

মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক মো: আবুল কালাম আজাদ বলছেন, প্রকল্পটি তুলনামূলক বেশি খরচ হলেও এটা সে অর্থে ব্যয়বহুল নয়।

“এটা প্রকৃতপক্ষে ব্যয়বহুল না। কারণ, এ প্রকল্পের সাথে প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা হলো পোর্টের কাজ। তো বিশ হাজার কোটি টাকা বাদ দিলে পঞ্চাশ হাজার কোটি থেকে থাকে ত্রিশ হাজার কোটি টাকা।”

“ত্রিশ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এইখানে সেকেন্ড ফেইজের জন্য আমার জায়গা অধিগ্রহণ করছি সেই জায়গার দাম আছে। এছাড়া সেকেন্ড ফেইজের কিছু কাজও করছি। যেরকম এর জেটির ক্যাপাসিটি হলো দুইটা ফেইজের জন্য। আমিতো এখন করতেছি একটা। আরেকটা ফেইজ যখন আমি করবো তখনতো ওই খরচটা মিনিমাইজ হয়ে যাবে,” বলেন মি.আজাদ।

তবে মাতারবাড়ী প্রকল্পে দ্বিতীয় পর্যায়ে আরো দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যে পরিকল্পনা করা হয়েছিল সেখানে নতুন করে অর্থায়ন করবে না জাইকা।

এখনো মাতারবাড়িতে তৃতীয় ও চতুর্থ ইউনিট নির্মাণে বিনিয়োগ বা অর্থায়নে এগিয়ে না আসায় আপাতত দ্বিতীয় পর্যায়ের কোনো অগ্রগতি নেই।

ভোক্তা অধিকার বিষয়ক বেসরকারি সংগঠন কনজ্যুমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বা ক্যাব-এর উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন , এ ধরনের যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়।

“এসবগুলো যুক্তি খাড়া করা হচ্ছে। এসব যুক্তি কখনো গ্রহণযোগ্য যুক্তি না, যুক্তিযুক্ত না। কবে আরেকটা ইউনিট তৈরি করবো সেই ইউনিট তৈরি করার পয়সা ওখানে ঢুকায় দেবো, এটা নিয়ম না। এটা বিধান না,” বলেন অধ্যাপক আলম।

আমদানি ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য কিছু সরঞ্জাম আমদানির একটি চালানে যে মূল্য ধরা হয়েছে সেটি সম্প্রতি আলোচনায় আসে।

দেশের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ওই চালানে ১৫ হাজার টাকার দুটি পাইপ কাটার কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ৯৩ লাখ টাকা। এছাড়া যে হাতুড়ি ১৬শ টাকায় পাওয়া যায় সেটি ১ লাখ ৮২ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

এরকম ১৯ ধরনের হ্যান্ড টুলস আমদানি হয়েছে ৫ থেকে ১৮,৫০০ গুন পর্যন্ত বেশি দাম ধরা হয়েছে। এ বিষয়ে সমালোচনার প্রশ্নে মাতারবাড়ী কর্তৃপক্ষ আমদানিকারকদের কাছে বিষয়টি নিয়ে জানতে চিঠি দেয়।

আমদানির বিষয়ে ঠিকাদার কোম্পানির কাছে বাংলাদেশ কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি যে চিঠি দিয়েছিল সে বিষয়ে কী জবাব এসেছে?

জানতে চাইলে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বিবিসিকে জানান, ঠিকাদার কোম্পানি জানিয়েছে তাদের উল্লিখিত দামই ঠিক আছে।
পত্রিকা

কী কারণে এত বেশি দাম যৌক্তিক? এ প্রশ্নে মি. আজাদ জানান, ১২০০ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সহনশীল বিশেষ ধাতু দিয়ে বানানোয় এর দাম বেশি। এবং আমদানিতে যে দর উল্লেখ করা হয়েছে সেটাই সঠিক।

প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদের দাবি এখানে কোনো অনিয়মও হয়নি।

সবমিলিয়ে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পকটি ব্যয় 'অস্বাভাবিক এবং অতিমূল্যায়িত' বলে মনে করেন জ্বালানি বিশ্লেষকরা।

ক্যাব- এর জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশে মাতারবাড়ী প্রকল্পটি অতিমূল্যায়নের একটি বড় দৃষ্টান্ত।

“তারা সবকাজ এভাবেই করেছে। ন্যায্য দাম হিসেবে কতগুণ বাড়িয়েছে সেটা আমরা কল্পনাই করতে পারবো না। এটা যে কতগুন বাড়তে পারে।”

এসব প্রকল্পের স্বচ্ছতা নেই বলেও মনে করেন মি. আলম, “স্বচ্ছতার তো প্রশ্নই ওঠে না। স্বচ্ছ করলে কি কেউ দ্রুত বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ আইন করে প্রতিযোগিতাহীণ করে? স্বচ্ছ করলে কি রেগুলেটরি কমিশনের আইন তুলে দিয়ে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ায়।”-অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

'অতিমূল্যায়নের' বিষয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এই সমস্ত অতিমূল্যায়নের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক এবং সেই অর্থে কারিগরি বিভিন্ন রকম রক্ষাকবজ আছে সরকারের ভেতর। রক্ষাকবজগুলো কাজ করেছি কী না এটা দেখার বিষয়।

“যেহেতু বিদেশি অর্থপুষ্ট প্রকল্প সেহেতু তাদের দোষত্রুটি খুজে বের করার চেষ্টা করবো এবং আমরা বলবো তারা বেশি পয়সা দিয়ে তাদের প্রযুক্তি বিক্রি করেছে। কিন্তু আমাদের দায়িত্বটা ভুলে যাবার কিছু নাই। কারণ আমাদের এখানে ব্যবস্থা ছিল সেই ব্যবস্থাগুলো আমরা কার্যকরভাবে ব্যবহার করেছি কী না দেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করার জন্য,” বলেন মি. ভট্টাচার্য।

জ্বালানি উপদেষ্টার ব্যাখ্যা
মাতারবাড়ী প্রকল্পটি শতভাগ সরকারি মালিকানার। এর জন্য প্রায় ৪৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ সহায়তা নিচ্ছে সরকার।

এ প্রকল্পের ব্য়য় বেশি বলে স্বীকার করেন জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

“জাপানি কন্ট্রাক্টররা ওরা অনেক সময় একটু ব্যয়বহুল হয়। আপনি তুলনা করলে দেখবেন জাপানি কন্ট্রাক্টরের সাথে অন্য কন্ট্রাক্টরের বিডে জাপানিদের একটু বেশি হয়। কিন্তু ওদের কাজটা কিন্তু আবার ভালো হয়," বলেন জ্বালানী উপদেষ্টা।
প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী।

প্রকল্প ব্যায় বৃদ্ধির কারণ নিয়ে উপদেষ্টা জানান, সময়ের সাথে সাথে কিছু ব্যয় বেড়েছে। জ্বালানী উপদেষ্টা বলেন, জাপানের অর্থায়ন না থাকলে এতো বড় প্রকল্প বাস্তাবায়ন করা সম্ভব হতো না।

“বড় কথা হলো এটা কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কিন্তু কোনো অর্থায়ন আর কেউ দেয়নি। চীন বাদে। জাপান সেখানে এগিয়ে এসেছিল।”

প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ জ্বালানি উপদেষ্টা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন কারণে এ প্রকল্পে খরচ বেশি। তবে তার দাবি মাতারবাড়ীকে কেবল বিদ্যুৎ প্রকল্প হিসেবে দেখা ঠিক হবে না।

“শুধু কয়লা প্রকল্পের মধ্যে যদি সীমাবদ্ধ না রেখে আপনি এলাকা উন্নয়ন দেখেন তাহলে কিন্তু এটা ওরকম ব্যয়বহুল মনে হবে না। এবং আমরা আস্তে আস্তে যদি অন্য প্রকল্প করতে পারি তাহলে এর কস্ট নেমে আসবে। তবে মূখ্যত ওই তৃতীয় এবং চতুর্থ ইউনিট না হওয়ার কারণে এটার কস্ট অনেক বেড়ে গেছে"

"অনেক ড্রেজিং করতে হয়েছে। বহু এলাকা সমূদ্র থেকে ড্রেজিং করে ভরাট করতে হয়েছে। এটা শুধু কয়লা বললে ঠিক হয় না। এটা বড় একটা প্রকল্প যেটা কয়লা ভিত্তিক বলতে পারেন। এইটা হওয়ার জন্য আশে পাশে অনেক শিল্প গড়ে উঠবে।”

“আমি মনে করি আমাদের যারা বিশ্লেষক তাদের এটার গভীরে যেতে হবে। প্রকল্প শুধু প্রকল্পকে ব্যাখা করলে এটা বোঝা যাবে না। এই প্রকল্পকে কেন্দ্র করে একদিন হয়তো সিঙ্গাপুরের মতো একটা শহর, দেশ গড়ে উঠবে ওখানে। সেজন্য ওইটা মাথায় রেখে এর আয় ব্যয় বিশ্লেষণ করা উচিত" বলেন জ্বালানী উপদেষ্টা।

মাতারবাড়ী প্রকল্পটিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয়। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য এ প্রকল্প বিষয়ে বলেন, মাতারবাড়ির বিদ্যুৎকেন্দ্রটিকে শুধুমাত্র বিদ্যুৎকেন্দ্র হিসেবে বিচ্ছিন্নভাবে দেখাটা ঠিক হবে না।

"এটাকে অবশ্যই ওখানে যে সমূদ্র সংযোগ তৈরি করা হচ্ছে, যে গভীর সমূদ্র বন্দর তৈরি করা হচ্ছে তার সাথে মিলিয়ে দেখা উচিৎ এবং এর অর্থনৈতিক সুবিধাটা শুধু বাংলাদেশের ভেতরে না দেখে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতার দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে," বলেন মি. ভট্টাচার্য।