Advertisement


জীববৈচিত্র‌্য ও সম্পর্কিত কথা

মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন
জীববৈচিত্র্য- প্রাকৃতিক পরিবেশে উদ্ভিদ, প্রাণী ও আণুবীক্ষণিক জীব সমূহের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে যে বাস্তুতন্ত্র গড়ে ওঠে, সেই বাস্তুতন্ত্রে অগণিত নানা ধরনের জীব প্রজাতির সমাহার বা সমাবেশকে জীববৈচিত্র্য বলে। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে W. G. Rosen স্কিসামিয়ান ইনস্টিটিউটের ন্যাশনাল ফোরামে সর্বপ্রথম জীববৈচিত্র্য তথা 'Biodiversity শব্দটি ব্যবহার করেন। পরবর্তীকালে IUCN ও UNEP “Biodeversity” শব্দটি গ্রহণ করে জীববৈচিত্র্যের যে সংজ্ঞা প্রদান করে তা হলো—কোনো একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের সমস্ত জিন, প্রজাতি ও বাস্তুতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও সমগ্রতাকে জীববৈচিত্র্য বা Biodiversity বলে। পৃথিবীর জীবমণ্ডলে প্রায় ২.২ কোটি প্রকার জীবের বাস। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৬ লক্ষ ৫ হাজার জীব প্রজাতিকে শনাক্ত করা হয়েছে। বাকিরা এখনো অশনাক্ত। উদ্ভিদ, প্রাণী ও জীবাণুর প্রত্যেক প্রজাতির মধ্যে যেমন স্বাতন্ত্র্যতা দেখা যায়, তেমনি একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যদের মধ্যেও গঠনগত বিভিন্নতা দেখা যায়। জীবমণ্ডলের সমগ্র জীবদের মধ্যে এই বিভিন্নতাই হলো জীববৈচিত্র্য।

 
অধ্যাপক হ্যামিল্টনের মতে- পৃথিবীর মাটি, জল ও বায়ুতে বসবাসকারী সব উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবদের মধ্যে যে জিনগত, প্রজাতিগত ও পরিবেশগত (বাস্তুতান্ত্রিক) বৈচিত্র্য দেখা যায় তাকেই জীববৈচিত্র্য বলে। পৃথিবীর ১০ বিলিয়ন ভাগের একভাগ অংশতেই ৫০ মিলিয়ন প্ৰজাতির বিভিন্ন জীব-জন্তু এবং উদ্ভিদের বসবাস৷ কোনো অঞ্চলের অন্তর্গত সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রাণীর জিনগত, প্রজাতিগত ও বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্নতা এমনকি একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির জিনগত বৈচিত্র্যও জীববৈচিত্র্যের অন্তর্গত। অর্থাৎ কোনো একটি অঞ্চলের অন্তর্গত প্রাকৃতিক বাসস্থান বা হ্যাবিট্যাট এবং ওই বাসস্থানে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণী, উদ্ভিদ ও অণুজীবের প্রজাতি এবং তাদের জিনগত বৈচিত্র্যের সমাহারকে এককথায় জীববৈচিত্র্য বা বায়োডাইভার্সিটি বলে। উল্লেখ্য যে, ১৯৬৮ সালে “বায়োলজিক্যাল ডাইভার্সিটি” (Biological diversity) কথাটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন বন্যপ্রাণী বিজ্ঞানী ও সংরক্ষণবিদ রেমন্ড এফ ডাসমান (Raymond F Dasmann)।
 
জীববৈচিত্র্যের শ্রেণিবিভাগ-
বৈচিত্র্যতার কারণের ভিত্তিতে জীবৈচিত্র‌্যতাকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করা যায়।
 
জিনগত বৈচিত্র্য-
একটি প্রজাতি থেকে অন্য প্রজাতির মধ্যে প্রাপ্ত জিনের সব বা একাধিক রকমের পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। জিনগত তারতম্যকে জেনেটিক ভেরিয়েবিলিটি (Genetic variability) বলা হয়। মিউটেশন (mutation) বা পরিব্যক্তি জিনের প্রবাহ ও জিনগত বৈচিত্র্য ঘটায়। উদাহরণ- Rauwolfia vomitoria উদ্ভিদের রোগ নিরাময়ের জন্য বন্য প্রজাতির রোগ প্রতিরোধী জিনগুলি প্রতিস্থাপন করে “ট্রান্সজেনিক ভ্যারাইটি”-এর উদ্ভিদ তৈরি করা হয়। যেমন- বন্য ধান (Oryza nivara)-র রোগ প্রতিরোধী জিন প্রতিস্থাপন করে ট্রান্সজেনিক ভ্যারাইটির ধান সৃষ্টি করা হয়েছে। এটি চার ধরনের ধানের রোগকে প্রতিহত করে।
 
 
প্রজাতিগত বৈচিত্র্য-
কোনো বাস্তুতন্ত্রে বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ, প্রাণী ও অনুজীবের উপস্থিতিকে প্রজাতিগত জীববৈচিত্র বা স্পিসিজ ডাইভার্সিটি (Species diversity) বলে। এই বৈচিত্র্য থেকে প্রজাতির সংখ্যা, শ্রেণি, বর্ণ, চরিত্র জানা যায়। নিরক্ষীয় বৃষ্টি অরণ্য বাস্তুতন্ত্রে প্রজাতিগত বৈচিত্র্য বা স্পিসিস ডাইভার্সিটি সবচেয়ে বেশি। একটি স্থানে অবস্থানকারী বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে যে বৈচিত্র্যতা লক্ষ করা যায় তাকে প্রজাতিগত জীববৈচিত্র্য বলে। এই ধরনের বিভিন্নতা একটা প্ৰজাতির অথবা বিভিন্ন প্ৰজাতির অন্তৰ্গত সদস্য সমূহের মধ্যে দেখা যায়৷ বিজ্ঞানী এড‌ওয়ার্ড উইলসনের (১৯৯২) মতে- বিশ্বে ১০ মিলিয়নের থেকে ৫০ মিলিয়ন জীবিত প্ৰজাতি আছে৷ তবে কেবল ১.৫ মিলিয়ন জীবিত প্ৰজাতির এবং ৩,০০,০০০ জীবাষ্ম প্ৰজাতি আবিষ্কার করে নামকরণ করা হয়েছে৷ ইতোমধ্যে বহু প্ৰজাতির প্ৰকৃতির সাথে ভারসাম্য রক্ষা করতে না পারায় বিলুপ্তি ঘটেছে৷ প্ৰজাতি বৈচিত্রর‌্যতা নিৰ্ণয় করার জন্য দুটা সূচক ব্যবহার করা হয় - শেন'ন উইনার সূচক এবং সিম্পসন সূচক। এটির আলোচনা এখানে দরকার নেই।
 
বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য-
একটি বিরাট অঞ্চল জুড়ে বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের প্রকারভেদকে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য বা ইকোসিস্টেম ডাইভার্সিটি (Ecosystem diversity) বলে। বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে জিনগত বৈচিত্র্য এবং প্রজাতিগত বৈচিত্রের কারণেও বাস্তুতান্ত্রিক বৈচিত্র্য ঘটে। প্রাকৃতিক পরিবেশে ভূমিরূপ, আর্দ্রতা, তাপমাত্রা এবং শক্তিপ্রবাহ আলাদা হয় বলে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য ঘটা সম্ভব হয়। হুইটেকার (Whittaker)-এর মত অনুসারে বাস্তুতান্ত্রিক জীববৈচিত্র্য নির্ধারণের তিনটি সূচক আছে। যেমন- (১) আলফা বৈচিত্র্য, (২) বিটা বৈচিত্র্য, (৩) গামা বৈচিত্র্য।
 
আলফা বৈচিত্র্য-
একটি নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক বাসভূমির (habitat) মধ্যে (যেমন- বনভূমি) বিভিন্ন প্রজাতি (species)-র গড় জীববৈচিত্র্যকে আলফা বৈচিত্র্য (α-Diversity) বলা হয়।
 
বিটা বৈচিত্র্য-
স্থানীয় জীববৈচিত্র্য (আলফা বৈচিত্র্য) এবং আঞ্চলিক (regional) জীববৈচিত্র্যের অনুপাতকে বিটা বৈচিত্র্য β-Diversity) বলা হয়। এই পদ্ধতিতে এক পরিবেশ থেকে অন্য পরিবেশের প্রজাতির বৈচিত্র্য সম্পর্কে জানা যায়।
 
গামা বৈচিত্র্য-
যে-কোনো খুব বড়ো ভৌগোলিক অঞ্চলের (যেমন- হিমালয় অঞ্চল) মধ্যে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক বাসভূমির পার্থক্যের জন্য বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রে থাকা জীব প্রজাতির যে সামগ্রিক বৈচিত্র্য তৈরি হয় তাকে গামা বৈচিত্র্য (γ-Diversity) বলা হয়। ভারতের মতো বড়ো দেশের জীববৈচিত্র্য হল গামা বৈচিত্র্য। গামা বৈচিত্র্যের ওপর নির্ভর করে জীববৈচিত্র্য আইন এবং ইকো-ট্যুরিজম (Eco Tourism) গড়ে তোলা হয়।
 
জীববৈচিত্র‌্য এর গুরুত্ব-
পৃথিবীতে জীববৈচিত্র্য আছে বলে পরিবেশে শক্তি প্রবাহ ঘটে। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রাণী ও কীটপতঙ্গ বেঁচে থাকে। বাস্তুতন্ত্র গতিশীল (dynamic) ও কার্যকর হয়। পরিবেশ রক্ষা ও দুর্যোগ নিবারণের ক্ষেত্রে জীববৈচিত্র্যের কার্যকর প্রভাব আছে। যেমন— ম্যানগ্রোভ অরণ্য ক্রান্তীয় ঘূর্ণবাত ও সুনামির প্রভাব থেকে উপকূল অঞ্চলকে অনেকটাই রক্ষা করতে সক্ষম। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ রক্ষা করা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করা, আধ্যাত্মিক ও নান্দনিক মূল্যবোধ তৈরি করা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও জীববৈচিত্র্য বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
 
জীববৈচিত্র্যের অর্থনৈতিক উপযোগিতা আছে। জীববৈচিত্র্য আছে বলে মানুষ খাদ্যের জোগান পায় শিল্পের কাঁচামাল পায়, প্রাত্যহিক জীবনের প্রয়োজন মেটায়, বিনোদন ও পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে পারে। ওষুধ প্রস্তুত করার জন্য ভেষজ কাঁচামালের জোগান জীববৈচিত্র্যই সুনিশ্চিত করে।
 
একটি সমাজ তৈরি করতে গেলে বিভিন্ন পেশার লোকের দরকার হয়, যারা নিজ নিজ কাজের দ্বারা সমাজকে টিকিয়ে রাখে। তেমনি একটি বাস্তুতন্ত্রের সুস্থায়ীভাবে টিকে থাকার জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজন হয়, যেখানে প্রত্যেক প্রজাতি তাদের নিজস্ব ভূমিকা পালন করে। যে কারণগুলির জন্য জীববৈচিত্র্যের প্রয়োজন হয় সংশ্লিষ্ট কয়েকটি হলো—
 
 
অর্থনৈতিক মূল্য-
মানুষ তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, ওষুধ প্রভৃতির জন্য সরাসরি প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। জীববৈচিত্র্যের জন্যেই মানুষ তার চাহিদা প্রকৃতি থেকে মেটাতে সক্ষম। জীববৈচিত্র‌্যতা না থাকলে এসব আহরণ করা একবারেই অসম্ভব। মাছের বড়ো অংশই নদী, সাগর ইত্যাদি থেকে আহরিত হয়। ফল, কাঠ, ফুল ইত্যাদির উৎসমূলও সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক। এরকম উদাহরণ আছে অজস্র।
 
 
নান্দনিক মূল্য-
বিভিন্ন প্রজাতির জীব প্রকৃতিকে বৈচিত্র্যময় ও সুন্দর করে তোলে। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রতিবছর অসংখ্য মানুষ পাহাড়, সমুদ্র সৈকত, বনাঞ্চল, জাতীয় উদ্যান প্রভৃতিতে ভ্রমণ করতে যায়। এ মূল্য আর্থিক মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি। ইন্দোনেশিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, আরব আমিরাত প্রভৃতি রাষ্ট্র কেবল এ খাত থেকেই বিশাল অংকের ডলার আয় করে।
 
 
নৈতিক মূল্য-
প্রত্যেক জীবের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে রাষ্ট্রপুঞ্জের বিশ্বপ্রকৃতি সম্পর্কিত ঘোষণাপত্রে এই চিন্তাধারা স্বীকৃতি পেয়েছে। তাই মানুষের কর্তব্য প্রতিটি প্রজাতির জীবকে এই পৃথিবীর বুকে বাঁচিয়ে রাখা। এ পৃথিবী কেবল মানুষের জন্য নয়। সৃষ্টি জগতের সকল সৃষ্টির জন্যই পৃথিবী। মানুষের পাশাপাশি বিভিন্ন প্রাণি, জীব, পতঙ্গ, গুল্ম, লতা-পাতা, বৃক্ষ সবারই এখানে বসবাস করার সমান অধিকার আছে। প্রয়োজনে তাদের বসবাসের জন্য আলাদা জায়গা করে দিতে হবে। কিন্তু, তাদের ধ্বংশ তথা জীববৈচিত্র‌্যতা নিশ্চিহ্ন করা যাবে না। যদি তাই করি এর ফল ভোগ করতে হবে আমাদেরকেই। আমরা প্রায় সময় পত্রিকায় সংবাদ দেখি- লোকালয়ে চলে এসেছে বাঘ/সিংহ/হাতি/শাপ। কথাটি আসলে সেরকম নয়। মানুষই তাদের প্রয়োজনে এসব প্রাণির বসবাসের জায়গা দখল করে নিয়ে বসবাস শুরু করে দিয়েছে অনেক আগে থেকেই। তাদের জায়গা দখল না করলে এ অবস্থা হতো না। নদী ভরাট করতেছি প্রতিনিয়ত, বৃক্ষ নিধন চলতেছে প্রতি মূহুর্তে। আপনার আমার পাশে এরকম হাজারো উদাহরণ আছে। চোখ বন্ধ করলেই দেখবেন।  
 
 
পরিবেশ রক্ষা-
প্রত্যেক জীব বাস্তুতান্ত্রিকভাবে একে অপরের উপর নির্ভরশীল। একটি জীবের বিনাশ অন্যকোনো জীবের বিপন্নতার কারণ হতে পারে। খুব সাধারণ বিষয়- ধরুন, সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কমে গেছে। বাঘ তাদের আহার হিশেবে হরিণ না পেয়ে ক্ষুধায় ভোগতে থাকবে। এক সময় অনেক বাঘের মৃত্যুর কারণ হবে কেবল খাদ্যাভাব। আমরা নদী ভরাট করে যখন সেখানে অন্য অন্য কিছু করব তখন নদীতে মাছসহ অন্যান্য উৎপাদন কমে যাবে। কমে যাবে বা একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে পানির স্বাভাবিক প্রবাহ। এর প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়বে মানুষের জীবনে। একটি সাধারণ পাখিও আমাদের মনুষ্য বসবাসের উপযুক্ত পরিবেশ গড়ে তুলতে বিরাট ভূমিকা রাখে। তাই মানুষের এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার প্রধান শর্ত হলো এই জীববৈচিত্র্যকে বাঁচিয়ে রাখা।
 
 
আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক মূল্য-
বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে উদ্ভিদ ও প্রাণীর আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্বের উল্লেখ আছে। হিন্দুধর্মে বিভিন্ন উদ্ভিদ যেমন-তুলসী, বট, অশ্বত্থ ইত্যাদি পূজোর বিধান আছে। হিন্দু দেবদেবীদের অনেকেরই বাহন হলো বন্যপ্রাণী। সেইসব প্রাণিদের হত্যা করা ধর্মে নিষিদ্ধ। পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মেও জীবের প্রতি অহিংসা প্রদর্শনের কথা বলা হয়েছে। পরিবেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে বর্তমানে ছোট ছোট অসংখ্য লতা, গুল্ম ইত্যাদি আর চোখে পড়ে না। এসব লতা আর গুল্ম অসংখ্য ওষধের প্রতিশেধক হিশেবে কাজ করতো। তাই মানুষের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক চেতনা রক্ষায় জীববৈচিত্র্যের বিশেষ ভূমিকা বর্তমান।
 
 
জীববৈচিত্র‌্য ও খাদ্য শৃঙ্খল-
জীববৈচিত্র‌্য এর অনেকগুলো আলোচনাযোগ্য টার্মের মধ্যে বাস্তুতন্ত্রে খাদ্য শৃঙ্খল একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাযোগ্য বিষয়। বিষয়টি বুঝানোর জন্য শৈশবের এক পুকুরের উদাহরণ টেনে আনবো। একটি পুকুরে নানা জাতের মাছ থাকে। যেমন, ছোট মাছদের ভেতর পুঁটি মাছ, টেংরা মাছ। আবার বড় মাছদের ভেতর রুই মাছ, বোয়াল মাছ। পুকুরে শ্যাওলা, শামুক, কীট, ব্যাঙাচি, ক্ষুদিপানা, শাপলা এসবও থাকে। পুকুরপাড়ে ব্যাঙ, পতঙ্গ, মেছোবাঘ থাকে। পুকুরের ধারে মানুষের ঘরবাড়ি থাকে। যদি পুকুরে সব শ্যাওলা মরে যায় বা যদি পুকুরপাড় থেকে ব্যাঙেরা কোথাও চলে যায় তবে কী হতে পারে? এমন ঘটলে পুকুরে খাদ্যসংকট দেখা দিবে, পরিবেশ বিনষ্ট হবে। সর্বোপরি এটি পুকুরধারের মানুষের পরিবারেও সংকট তৈরি করবে।ন এটিই খাদ্য শৃঙ্খল। বাস্তুতন্ত্রে খাদ্য শৃঙ্খলের সর্বনিম্ন স্তর হলো উৎপাদক। উৎপাদক নিজের খাদ্য তৈরির জন্য কারো উপর নির্ভর করে না। যেমন- শৈবাল, ফাইটোপ্ল্যাংটন। খাদ্যশৃঙ্খলে মাধ্যমিক স্তর হলো খাদক। এদের স্তর তিনটি। ১ম স্তরের খাদক খাদ্যের জন্য উৎপাদকের উপর নির্ভর করে। যেমন- ঘাস ফড়িং। ২য় স্তরে থাকা গরু, মুরগি, ছাগল হাঁস ১ম স্তরের উপর ‍নির্ভর করে। একইভাবে ৩য় স্তরের খাদক নির্ভর করে ২য় স্তরের উপর। ৩য় স্তরে রয়েছে মানুষ, বাঘ ইত্যাদি। এরপর আছে বিয়োজক। এরা ৩য় স্তরের খাদকের মৃত্যুর পর তা বিয়োজনে কাজ করে। সমগ্র শৃঙ্খলটি এক অপরের উপর নির্ভরশীল। যেকোনো একটি স্তর না থাকলেই শৃঙ্খলটি ভেঙে পড়তে বাধ্য। এ থেকে জীববৈচিত্র‌্য এর গুরুত্ব অনুধাবন করা যায়।
 
বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য-  
বিজ্ঞানীদের নানা হিসাব মোতাবেক জীব প্রজাতির সংখ্যা (জীবন্ত) ৩০ লাখ থেকে তিন কোটি, তন্মধ্যে মাত্র ১৬ লাখ প্রজাতি শ্রেণীবিন্যস্ত হয়েছে এবং তাতে আছে প্রায় আড়াই লাখ উদ্ভিদ, সাড়ে সাত লাখ কীটপতঙ্গ, ৪১ হাজার মেরুদণ্ডী, বাকিরা অন্যান্য অমেরুদণ্ডী, ছত্রাক, শৈবাল ও অণুজীব। এখনো অনেক প্রজাতি অনাবিষ্কৃত। এ বৈচিত্র্যের অধিকাংশই রয়েছে পৃথিবীর গ্রীষ্মমণ্ডলে, আর্দ্র-উষ্ণ এলাকায়, বিশেষত বনাঞ্চলে। বাংলাদেশে ১৭৫ প্রজাতির ভেষজ উদ্ভিদ রয়েছে। আট থেকে দশ হাজার বছরের পুরনো কৃষি সভ্যতার ধারাবাহিকতার ফসল হলো এখানকার চাষিদের হাতে উৎপন্ন ধান, পাট, আখ, তুলা, তিসি, সরিষা, সবজি, ফলমূল ইত্যাদির অজস্র প্রকারভেদ। বসতবাড়ির আঙিনায়ও অনেক জাতের গাছগাছড়া জন্মে।
 
বাংলাদেশে জীববৈচিত্র্য ধ্বংশের পরিসংখ্যান-
 সম্প্রতি বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়, বন উজাড় হওয়ায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংশসহ পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বহুগুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশ্বের সর্বত্র বন উজাড় হচ্ছে এবং বন্যপ্রাণী নিধন হচ্ছে। বাংলাদেশে এই হার অন্য দেশগুলোর চাইতে কোনো অংশে কম নয়। অনেক ক্ষেত্রে বরং বেশিই। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশে বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ, ২.৬ শতাংশ। বিগত দেড়যুগে বাংলাদেশে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেন ফরেস্ট নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আর বন বিভাগের হিসাবে সারা দেশে দখল হয়ে গেছে দুই লাখ ৮৭ হাজার ৪৫৩ একর বনভূমি।
 
বাংলাদেশে প্রাণিজ জীববৈচিত্র্য ও সংকট-
বাংলাদেশ প্রাণিজ সম্পদে পরিপূর্ণ। মাছ, উভচর, সরীসৃপ, পাখি ও স্তন্যপায়ীরা এ দলের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের বনভূমি ও জলাভূমি মেরুদণ্ডী প্রাণীতে সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের প্রায় ১,৬০০ প্রজাতির মেরুদণ্ডীর মধ্যে রয়েছে ৬৫৩ প্রজাতির মাছ, ৩২ প্রজাতির উভচর, ১২৬ প্রজাতির সরীসৃপ, ৬২৮ প্রজাতির পাখি ও ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ী। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজার্ভেশন ফর ন্যাচার, বাংলাদেশের তথ্যমতে, দেশে বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীই আজ বিপন্ন। বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে রয়েছে ৫৪ প্রজাতির মাছ, ৮ প্রজাতির উভচর, ৫৮ প্রজাতির সরীসৃপ, স্থায়ী বাসিন্দা পাখি ৪০ এবং অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ী ৪০ প্রজাতির। বাংলাদেশের সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের অন্যতম নিদর্শন আমাদের জলাভূমিগুলো। পৃথিবীবিখ্যাত সুন্দরবন ও টাংগুয়ার হাওর আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত দুটি জলাভূমি (রামসার সাইট)। টাংগুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। প্রতি বছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে হাওরটিতে।
 
হাজার মাইল অতিক্রম করে অসংখ্য পরিযায়ী পাখির আগমনও বাংলার জীববৈচিত্র্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাড়ে ছয় শতাধিক পাখির মাঝে জলচর পাখিই বেশি। জলাভূমির পাখির ১০ শতাংশ স্থানীয়, বাকি ৯০ শতাংশই অতিথি পাখি। এর মাঝে রয়েছে ২৮ প্রজাতির হাঁস এবং ১৮ প্রজাতির গাঙচিল।
 
বাংলাদেশের ১১৯ প্রজাতির অভ্যন্তরীণ স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৪০টি নানা পর্যায়ের বিপদের সম্মুখীন। ১১ অত্যন্ত বিপন্ন, ১৩ বিপন্ন, ৬ বিপন্নপ্রায়। বর্তমানে ১৭ প্রজাতি বিপদমুক্ত। বঙ্গোপসাগরের স্তন্যপায়ীর মধ্যে ৩ প্রজাতির তিমি পৃথিবীর সর্বত্রই বিপন্ন। নীল তিমি ও পাখনাওয়ালা তিমি বিপন্ন এবং কুঁজো তিমি বিপন্নপ্রায়।
 
যেখানেই মানুষ সেখানেই ধ্বংশ-
জলে-স্থলে এবং অন্তরীক্ষে সর্বত্রই কোনো না কোনোভাবে জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। মূলত মানুষের অযাচিত হস্তক্ষেপেই জীববৈচিত্র্য আজ হুমকির মুখে। আমরা সবাই জানি, মহামারী, দুর্ভিক্ষ আর যুদ্ধবিগ্রহের কারণে জীববৈচিত্র্যের অনেক পরিবর্তন ঘটে থাকে। এখন এসব কারণ ছাড়াও মানবসৃষ্ট অনেক কারণেই আমাদের জীববৈচিত্র‌্য ধ্বংশ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। প্রতিনিয়তই বন উজাড় হচ্ছে, নদী হারিয়ে যাচ্ছে। অথচ, আমাজনের গহিন জংগলে, সমুদ্রের গভীর তলদেশে কিংবা অসীম মহাশূন্যে কোথাও জীববৈচিত্র্যের ধ্বংশের চিহ্ন নেই। যেখানে মানুষ, সেখানেই ধ্বংশ হচ্ছে পরিবেশ তথা জীববৈচিত্র‌্যতা।
উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো- ১৭৯৮ সালের ৩০ মার্চ হতে ২ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে বৃটিশ আমলা ও চিকিৎসক ফ্রান্সিস বুকানন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নির্দেশে বৃহত্তম চট্টগ্রাম ভ্রমণের অংশ হিশাবে মহেশখালী ভ্রমণ করেন। তার ভ্রমণ বৃত্তান্তের কয়েকটি ছত্র এরকম-
“Muscally by nature is a delightful island,........ It might perhaps be of advantage to the Company, to make dams a cross the mouths of all the creeks, which admit the tide into Mascally, and thus to encourage the natives to clear the land.” (প্রকৃতিগতভাবে মহেশখালী একটি অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ,......... কোম্পানির জন্য ইহা অত্যন্ত লাভজনক হবে, যে সকল নদ-নদী-খাল-নালা দিয়ে মহেশখালীতে জোয়ারের পানি প্রবেশ করে বাঁধ নির্মাণ করে ইহাদের মুখ বন্ধ করা এবং অতপর স্থানীয় জনগণকে ভূমি সংস্কার করার জন্য উৎসাহিত করা।) (মহেশখালী বাংলা বানানে প্রচলিত রীতি অনুসরণ করেছি)
বুকাননের বর্ণনায় আরো কয়েকটি ছত্র এরকম- “The most esteemed trees, growing naturally on Mascally, are the Boidea and Doolea Gurgeons; the Bassua and Keta Jarools (Lagerstromia Flos Reginae of Konig, and a variety of it with a thorny stem) of which the last is most esteemed; the Tetuia Taelsaree; the Hoorina Ussual (a Species of Vitex); the good gootea; the Soondur (Heritiera littoralis Hort: Kew: which is really a Sterculea); and the Roona, which in the Soonderbunds is called Pursur. this is a Species of Trichilia not described)”. (মহেশখালীতে প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত গাছসমূহের মধ্যে গর্জন, জারুল, তেতুল, তেশ্বল, আশ্বল, সুন্দর, গুটগুটিয়া, চান্দুল, রুনা, হরিনা ইত্যাদি অতি মূল্যবান।) বুকানন খুব কম এলাকা ঘুরে এসব গাছের অস্থিত্ব পেয়েছিলেন এবং তার বর্ণনা তুলে ধরেছিলেন। এসব গাছের কয়টি এখন দেখতে পাই? প্রায়ই এখন বিলুপ্ত। যা আছে তা সংখ্যায় খুব নগণ্য। উল্লেখ্য যে, বুকানন কর্তৃক মহেশখালী ভ্রমণের প্রায় সম-সামসয়িক সময়ের মাত্র কিছু সময় আগে থেকে মহেশখালীতে মানুষের বসবাস শুরু হয়। এরপরের অবস্থা যাচ্ছেতাই। কিছু বছর আগেও প্রায় সব জায়গায় গুই সাপ দেখতে পাওয়া যেতো, এখন তা নেই বললেই চলে। বিভিন্ন প্রজাতির লতা, গুল্ম, গাছ ইত্যাদির বিলুপ্তি ঘটেছে এখন।  
 
জীববৈচিত্র্য ধ্বংশের কারণ-
সমগ্র বিশ্বেই জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটে চলেছে। ইউনাইটেড ন্যাশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের হিসাবে বিশ্বে প্রায় ২.২ কোটি জীব প্রজাতি রয়েছে। আগামী ৩০ বছরের মধ্যে ৭০ লাখ জীবপ্রজাতি বিলুপ্ত হতে পারে। পাখি ও সরীসৃপসহ নানা প্রজাতির মধ্যে যথাক্রমে তিন-চতুর্থাংশ ও এক-চতুর্থাংশ বিলুপ্তির পথে। নির্বিচার অরণ্য ধ্বংশের ফলে মোট সপুষ্পক উদ্ভিদের প্রায় ১০ শতাংশ আজ বিলুপ্তপ্রায়। উদ্ভিদ ও প্রাণীর এই বিলুপ্তির একাধিক প্রাকৃতিক, মনুষ্যসৃষ্ট এবং মিশ্র কারণ রয়েছে।
 
 
জলবায়ুর পরিবর্তন-
বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক যুগে একাধিকবার জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটেছে। এর পরিবর্তনের সাথে বিভিন্ন প্রজাতি অভিযোজন ঘটাতে না পারায় তাদের বিলুপ্তি ঘটেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রাকৃতিক কারণের সাথে মানবসৃষ্ট কারণ যুক্ত হয়ে আজ বিশ্ব জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে।
 
 
জীববৈচিত্র্য বিলুপ্তির মনুষ্যসৃষ্ট কারণসমূহ-
পৃথিবীতে জনসংখ্যার অত্যধিক চাহিদা পূরণ করার জন্য নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংশ করা হচ্ছে। এর ফলে উদ্ভিদের বিভিন্ন প্রজাতি ও প্রাণী ধ্বংশ হয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেক প্রাণির বিচরণের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা দরকার। তাদের আবাসস্থলের সংকোচন হলে তারা ঠিকমতো প্রজনন করতে পারে না। মানুষের তথাকথিত উন্নয়নমূলক কার্যকলাপ, যেমন বনাঞ্চল কেটে কৃষিজমির সম্প্রসারণ, আবাসন প্রকল্প তৈরি, কলকারখানা স্থাপন প্রভৃতির জন্য অরণ্যাঞ্চল ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে ও জীববৈচিত্র্যের বিনাশ ঘটছে।
 
 
বিদেশ থেকে আগত প্রজাতি-  
যেকোনো বাস্তুতন্ত্রের নিজস্ব গঠনবৈচিত্র্য থাকে। বাইরে থেকে হঠাৎ কোনো হিংস্র প্রকৃতির প্রজাতি এলে সেখানকার বাস্তুতন্ত্রের গঠন বিনষ্ট হয়। এতে স্থানীয় প্রজাতির বৈচিত্র্য ভীষণভাবে হ্রাস পায়।
 
 
বন্যপ্রাণির সংহার-
বিভিন্ন বন্যজীব নির্বিচারে হত্যা করার ফলে সেই প্রজাতিগুলো ক্রমান্বয়ে বিপন্ন হয়ে পড়ছে। হাতির দাঁত, বাঘের চামড়া, গণ্ডারের খড়গ প্রভৃতির জন্য সেই জীবদের এমন হারে হত্যা করা হয়েছে যে বর্তমানে তারা বিলুপ্তপ্রায় বলে গণ্য হচ্ছে।
 
 
অত্যধিক হারে উদ্ভিদ আহরণ-
বিভিন্ন আয়ুর্বেদিক ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলো তাদের চাহিদা পূরণ করার জন্য বনাঞ্চল থেকে নির্বিচারে বিভিন্ন বৃক্ষলতা ও গুল্ম আহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে। আবার পরিপক্কতা লাভের আগেই কেটে ফেলা হচ্ছে কাষ্টল বৃক্ষ। দেশের সর্বত্র এ অবস্থা বিরাজমান। এর ফলে একদিকে যেমন জীববৈচিত্র্যপূর্ণ বনাঞ্চল থেকে ভেষজ গুণসম্পন্ন গুল্মগুলো সংখ্যায় অতি দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে অপর দিকে নির্দিষ্ট এলাকা থেকে বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষও হারিয়ে যাচ্ছে প্রায়।
 
 
বিভিন্ন প্রকারের দূষণ-
সভ্যতার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতিতে জলদূষণ, বায়ুদূষণ ও মাটি দূষণের মাত্রা প্রভূত পরিমাণে বাড়ছে। দূষণের ফলে অনেক উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত্যু ঘটছে। এর পেছনে বিভিন্নক্ষেত্রে ব্যবহৃত কীটনাশকসহ মনুষ্যসৃষ্ট অন্যান্য কারণ মুখ্যত দায়ী বলে মনে করা হচ্ছে। অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য কৃষি জমির জীববৈচিত্র্যের পরিবর্তন ঘটে। বর্তমানে চিলসহ এজাতীয় বিভিন্ন পাখির সংখ্যা হ্রাসের কারণও প্রকৃতির দূষণ।
 
 
পরিকল্পনাবিহীন উন্নয়ন-
যেকোনো উন্নয়নকাজে হাত দেওয়ার আগে পরিবেশের ওপর তার প্রভাব সম্পর্কে সমীক্ষা করে নেওয়া প্রয়োজন। রাস্তা, রেললাইন, ব্রিজ, বাঁধ, অপরিকল্পিত জলাধার-খাল নির্মাণ, খাল নদী ভরাট, খনি, অরণ্যনিধন, অপরিকল্পিত কৃষিজমি ও আবাসভূমির সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের কারণে জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি হয়। দেশে দেশে ইতোমধ্যেই বেশ বাঁধ, জলাধার, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি নির্মাণ করা হয়েছে, যেগুলোর অনেকটির পরিবেশগত ঝুঁকি আগে থেকে বিশ্লেষণ করা হয়নি। এর ফলে এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ণে বিস্তীর্ণ বনাঞ্চল ধ্বংস করা হয়েছে। একটি নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এসব উন্নয়ন পরিকল্পনা করা হলে জীববৈচিত্র্যতা রক্ষা পাওয়া সহজ হতো, আবার উন্নয়ন পরিকল্পনাও ত্বরান্বিত হতো। প্রায় ক্ষেত্রে দেখা যায়- উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য রাষ্ট্র যে আদেশ প্রদান করে মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়ন হয় না মোটেই। যেমন- একটি নির্দিষ্ট জায়গায় কারখানা স্থাপনের জন্য সরকার থেকে সেখানে কারখানা স্থাপনের আগেই ১০০০ গাছের চারা রূপন করতে বলা হলো। স্থানীয় কর্তৃপক্ষ সে আদেশ পালন না করেই কারখানা স্থাপনের কাজ সম্পন্ন করে ফেলে। সরকার তো আর পাহারা বসায় রাখেনি। এখন দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখবেন- গত কয়েক বছরে গভীর নলকূপের পানির স্তর বেশ নীচে নেমে গেছে। এর ফলে বিভিন্ন জায়গায় সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে বা অনেক জায়গায় সুপেয় পানি পাওয়াও যাচ্ছে না। বিভিন্ন গবেষণা মতে, একই কারণে আগামি ২৫/৩০ বছর পর সুপেয় পানির ব্যাপক সংকট দেখা দিবে, তখন এটিই হবে বড়ো চ্যালেঞ্জ। অতএব, সবারই দায়িত্ববান হওয়া বেশ জরুরি।
 
   
অপর্যাপ্ত আইনি ব্যবস্থা-
এটি খুব সত্য কথা যে, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য আজ পর্যন্ত কার্যকর ও পর্যাপ্ত আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা হয়নি। আবার অনেক ক্ষেত্রে আইন প্রণয়ন হলেও তার প্রয়োগ দেখতে পাওয়াটা যেন সোনার হরিণ। ফলে বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণি নির্বিচারে নিধন করা হচ্ছে। যতো দিন না উপযুক্ত ও কার্যকর আইন প্রণয়ন ও কঠোরভাবে বলবৎ করা হবে- ততোদিন জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ অসম্ভব।
 
 
জীববৈচিত্র্য বিনষ্টের কিছু মোটা কারণ-
১. জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য।
২. ভূমিকম্প, উল্কাপাত, অগ্ন্যুৎপাত, সুনামি, দাবানল, খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক দুর্যোগের
৩. অধিক রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের জন্য।
৪. অপরিকল্পিত রাস্তা, রেললাইন, ব্রিজ, বাঁধ, জলাধার, খাল নির্মাণ, খনি, অরণ্যনিধন, কৃষিজমির সম্প্রসারণ, নগরায়ণ ও শিল্পায়নের জন্য।
৫. বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষণের জন্য।
৬. জীবগোষ্ঠীর প্রাকৃতিক বাসভূমি বা স্বাভাবিক বাসস্থান (habitat) বিনষ্ট হওয়ার জন্য ও অতিরিক্ত শিকার করার জন্য।
৭. বিদেশ বা অন্য কোনো জায়গা থেকে আসা আগন্তুক হিংস্র জীবপ্রজাতির আগ্রাসনের কারণে। উল্লেখ্য যে কচুরিপানা (water hyacinth), ল্যানটানা (lantana), ইউক্যালিপটাস (eucalyptus) প্রভৃতি বিদেশি উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে আগ্রাসী বৈশিষ্ট্য আছে। এরা স্থানীয় উদ্ভিদ প্রজাতিকে নষ্ট করে।
 
 
জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ-
‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণ সংস্থা’ (আইইউসিএন) বিপন্ন বা লুপ্তপ্রায় জীবপ্রজাতির যে একটি বিশদ তালিকা প্রকাশ করেছে সেটি রেড ডাটা বুক নামে পরিচিত। রেড বুক তালিকা অনুসারে বর্তমানে প্রায় ১,৪২,৫০০টি প্রজাতিকে বিপন্ন বলা হয়েছে। অবলুপ্তির প্রকার ও গুরুত্বের সাপেক্ষে এদের আবার নয় ভাগে ভাগ করা হয়েছে, যথা- লুপ্ত, বন্য পরিবেশে লুপ্ত, চরম বিপন্ন, বিপন্ন, বিপদাপন্ন, বিপদের স্বল্প লক্ষণ, অনুদ্বিগ্ন প্রজাতি, স্বল্প জ্ঞাত, অনির্ধারিত বা অমূল্যায়িত। যে তালিকায় অবলুপ্তির বিপদমুক্ত জীবপ্রজাতির উল্লেখ থাকে, তাকে গ্রিন ডাটা বুক বলে। যে তালিকায় ক্ষতিকর বা হানিকর জীবপ্রজাতিসমূহের উল্লেখ থাকে, তাকে ব্লাক ডাটা বুক বলে।
 
 
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় বাংলাদেশের পদক্ষেপ-
স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ সেল ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন প্রণয়ন করা হয়। ১৯৯২ সালের ২২ মে বাংলাদেশ বায়োডাইভার্সিটি (সিবিডি) চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। বর্তমানে এই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশের সংখ্যা ১৯৫টি। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে রাষ্ট্র কেবল গুরুত্বই দেয়নি বিষয়টি সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানে বলা হয়েছে- ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ এ ছাড়াও পরিবেশ সংরক্ষণে আইন রয়েছে। রয়েছে পরিবেশ আদালতও। যা দেশের পরিবেশবাদী মানুষের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক ব্যাপার। দেশে গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় উদ্যান, সাফারি পার্ক, অভয়ারণ্য। জাতিসংঘের জীববৈচিত্র্য সনদের পক্ষ হিসাবে বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে ‘বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন’ প্রণয়ন করেছে।
 
 
শেষ কথা-
এতোসব কথার মূল কথা হলো- জীববৈচিত্র‌্যতা দরকার আমাদের স্বার্থেই, আমাদের বাঁচার জন্যই। জীববৈচিত্র‌্য রক্ষার কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও প্রয়োজন আরো সমন্বিত ও প্রকৃতই আন্তরিকতা। এ কথা আজ জানতে হবে, বুঝতে হবে- আজকাল বিশ্বের তাপমাত্রা তো আর এমনে এমনে বৃদ্ধি পায়নি! খাদ্য সংকট বিনা কারণে হচ্ছে না। বিভিন্ন জায়গায় মাছের সংকট দেখা দেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

 
লেখক-
মুহম্মদ হেলাল উদ্দিন
পরিদর্শক
বাংলাদেশ পুলিশ।