# মামলার বিষয়ে অবগত নেই ভিকটিম ও বাদী
# বাদি ২০ বছরে একবারও চট্টগ্রাম শহরে যাননি
# মামলায় আসামি করা হয়েছে শিক্ষক,বিএনপি নেতাকর্মী,দিনমজুর, লবণ চাষী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের
# মামলায় বাদ দেওয়ার নামে আসামিদের কাছে মুঠোফোনে চাঁদদাবি
# মামলা ও চাঁদাদাবি কারা করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে শাস্তির দাবি - বাদির
রকিয়ত উল্লাহ।। গত ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার সমাবেশে হামলা করে পুলিশ, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা। হামলায় অনেকের সঙ্গে গুরুতর আহত হন কক্সবাজারের মহেশখালীর কালারমারছড়ার নির্মাণ শ্রমিক সাইফুল ইসলাম(২১)। তিনি ঐদিনই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৩দিন চিকিৎসা নিয়ে তার পিতা রফিক উদ্দিন ও বোন মোবাশ্বেরা বেগমের সাথে মহেশখালীর কালারমারছড়া আঁধারঘোনা গ্রামে চলে আসেন।
ঘটনার দেড় মাস পর ৩১ আগস্ট আহত সাইফুলের মা ফাতেমা বেগম (৪৯) বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় এজাহারনামীয় ৪৪ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা করেন।
কিন্তু মামলার বাদী মহেশখালীর ফাতেমা বেগম এবং তাঁর আহত ছেলে সাইফুল ইসলাম মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না এবং এঘটনায় কাদেরকে আসামি করা হয়েছে এবিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন বাদী। ফাতেমা বেগম আরও জানান -গত ২০ বছরে তিনি একবারও চট্টগ্রাম শহরে যাননি। মামলার বিষয়ে প্রতিবেদকদের কাছে প্রথমই শুনেছেন।এমনকি এ ঘটনায় পুলিশের কেউ যোগাযোগ করেননি বলে জানান।
অথচ এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিম (৪৫), সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিকে (৩৭)। ঘটনা চট্টগ্রাম শহরে হলেও আসামি করা হয় কক্সবাজারের পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, রাউজান, চান্দনাইশসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষজনকে। এর মধ্যে প্রবীণ শিক্ষক, লবণচাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও রয়েছেন। রয়েছেন বিএনপি নেতা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীও। মামলার পর বাদীর নাম দিয়ে কয়েকজন আসামির কাছ থেকে চাঁদা দাবিরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই বেলা তিনটার দিকে ফাতেমা বেগমের ছেলে সাইফুল তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করেন। কালা মিয়া বাজার থেকে মুরাদপুর মোড়ে এলে আসামিরা দলবদ্ধ হয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর লোহার রড, দা, কিরিচ, হাতুড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আসামিদের হাতে বাঁশ, কাঠের লাঠি, ইট-পাথর, লোহার রড ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। হত্যার উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারধর, গুলিবর্ষণের ঘটনায় সাইফুলসহ অনেকেই গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন। লোহার রড ও হাতুড়ির আঘাতে সাইফুলের মাথা ফেটে যায়। বাম পা ও হাতে প্রচণ্ড জখম হয়। একজন রিকশাচালক সাইফুলকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে সাইফুলের মাথায় সেলাই দেওয়া হয়। চমেক হাসপাতালে রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাইফুলকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান মা ফাতেমা বেগম। মামলায় উল্লেখ করা হয় সাইফুল দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর পড়েননি। মামলায় ফাতেমার স্বাক্ষর থাকলেও তিনি নিরক্ষর বলে নিজেই জানিয়েছেন।
সরেজমিনে মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের আঁধারঘোনা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় ফাতেমা বেগম ও তাঁর আহত ছেলে সাইফুলের সঙ্গে। এ সময় গ্রামের অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
পাঁচলাইশ থানাতে মামলার কথা শুনে অবাক হন ফাতেমা বেগম। মামলা দূরের কথা গত কয়েক বছরে একবারও চট্টগ্রামে যাওয়া হয়নি দাবি করে ফাতেমা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী রফিক উদ্দিনের আয়ে চলে তাঁদের টানাপোড়েনের সংসার। নদীতে স্বামী মাছ ধরতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হয়। দুই মেয়ের বিয়ে হলেও এক ছেলে সাইফুল কয়েক মাস ধরে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) চালিয়ে সংসারে কিছু অর্থের জোগান দিচ্ছেন। টাকার অভাবে সাইফুলের পড়ালেখা হয়নি, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল।
১২ বছর আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মোহাম্মদ শাহ ঘোনার ফাতেমা বেগমের শ্বশুরবাড়ি বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এরপর স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি আশ্রয় নেন বাপের বাড়ি আঁধার ঘোনাতে। মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ঘর তুলে কয়েক বছর ধরে সেখানে থাকছে ফাতেমার পরিবার।
ফাতেমা বেগম বলেন, গত ১০ জুলাইয়ের দিকে সাইফুল রাজমিস্ত্রির কাজ করতে চট্টগ্রাম শহরে যান। ১৬ জুলাই বিকেলে রাজমিস্ত্রির কাজ শেষ করে ভাড়া বাসায় ফেরার পথে মুরাদপুর এলাকায় ছাত্রলীগ-পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে পড়ে যান তিনি। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। স্থানীয় কিছু লোক তাঁকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। তিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর বাবা ও বড় বোন হাসপাতালে গিয়ে সাইফুলকে মহেশখালীতে নিয়ে আসেন। এরপর সাইফুল আর চট্টগ্রামে যাননি। ফাতেমা নিজেও গত ২০ বছর চট্টগ্রামে যাননি বলে দাবি করেন।
মায়ের পাশে বসে একই কথা বলেন সাইফুল। তিনি বলেন, পাঁচলাইশ থানায় গিয়ে তাঁর মা মামলা করবেন দূরের কথা, মহেশখালী থানায় যাতায়াতের সামর্থ্য তাঁদের নেই। কে বা কারা তাঁর মায়ের নাম ব্যবহার করে মামলা করেছেন—তার তদন্ত হওয়া দরকার।
সেখানে উপস্থিত ফাতেমার প্রতিবেশী কামরুল ইসলাম বলেন, সাইফুলের মা ফাতেমা বেগম নিরক্ষর। তিনি সই করতে জানেন না। একই কথা বলেন, কালারমারছড়া ইউনিয়নের আঁধার ঘোনা ৯ ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু আহমেদও। তিনি বলেন, ফাতেমা বাদী হয়ে মামলা করলে তাঁরা জানতেন। মামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেননি।মামলার এজাহারে ফাতেমা বেগমের সই আছে। তবে ফাতেমা নিজেই জানান, তিনি নিরক্ষর।
#পূর্বশত্রুতার_জেরে_আসামি
পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে ১৭ নম্বর আসামি করা হয় কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের রকবত আলী পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুর হোসেনকে (৫৮)। তাঁর প্রকৃত নাম নুর হোসেন সিকদার, বয়স ৬৭। তিনি বান্দরবানের আলীকদম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দীর্ঘ ২০ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৭ সালে অবসর নেন। এরপর তিনি পেকুয়ার নিজ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করছেন। সম্প্রতি পেকুয়া থানার এএসআই মো. সামছুদ্দীন ভূঁইয়া মামলার তদন্তে গেলে বিষয়টি জানতে পারেন তিনি।
নুর হোসেন সিকদার বলেন, গত ছয়-সাত মাসের মধ্যে তিনি একবারও চট্টগ্রাম যাননি। বাদীকেও তিনি চেনেন না। তবে কিছুদিন আগে বাদীর নাম উল্লেখ করে একজন নারী তাঁর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা পাঠানোর জন্য একটি বিকাশ নম্বরও দেন। অন্যথায় কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেন। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের সঙ্গে তাঁর মামলা আছে। তাঁদের কেউ মামলায় তাঁর নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে তাঁর সন্দেহ।
২২ নম্বর আসামি কুতুবদিয়ার উত্তর কৈয়ারবিলের তমিজ উদ্দিনে ছেলে সেলিম উদ্দিন (৩৫)। তাঁর প্রকৃত বয়স ৪৫। সেলিম বলেন, ২০২২ সালে কুতুবদিয়ার কয়েকজনের বিরুদ্ধে তিনি বাদী হয়ে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছিলেন। আসামিরা চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় থাকেন। সুযোগ পেয়ে তাঁদের কেউ হত্যাপ্রচেষ্টা মামলাতে তাঁর নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং এলাকায় থেকে লবণ ব্যবসা করছেন। বর্তমানে তিনি কুতুবদিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য এবং কৈয়ারবিল ইউনিয়ন বিএনপির অর্থ সম্পাদক।
কৈয়ারবিল ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি শফিউল আলম ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, সেলিম উদ্দিন বিএনপির ত্যাগী একজন কর্মী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
ফাতেমা বেগমের নামে মামলা নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তী অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থানায় এসে অনেকে মামলা করেছেন। তখন তদন্ত করে মামলা রেকর্ড করার সুযোগ ছিল না। এখন সেসব মামলার তদন্ত চলছে। এজাহারে নিরপরাধ কাউকে যদি আসামি করা হয়, সে ক্ষেত্রে পরে বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে।
ঘটনার দেড় মাস পর ৩১ আগস্ট আহত সাইফুলের মা ফাতেমা বেগম (৪৯) বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় এজাহারনামীয় ৪৪ জন এবং অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনের বিরুদ্ধে একটি হত্যাচেষ্টার মামলা করেন।
কিন্তু মামলার বাদী মহেশখালীর ফাতেমা বেগম এবং তাঁর আহত ছেলে সাইফুল ইসলাম মামলার বিষয়ে কিছু জানেন না এবং এঘটনায় কাদেরকে আসামি করা হয়েছে এবিষয়ে কিছু জানেন না বলে দাবি করেন বাদী। ফাতেমা বেগম আরও জানান -গত ২০ বছরে তিনি একবারও চট্টগ্রাম শহরে যাননি। মামলার বিষয়ে প্রতিবেদকদের কাছে প্রথমই শুনেছেন।এমনকি এ ঘটনায় পুলিশের কেউ যোগাযোগ করেননি বলে জানান।
অথচ এ মামলায় প্রধান আসামি করা হয় চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি এম আর আজিম (৪৫), সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল আজিম রনিকে (৩৭)। ঘটনা চট্টগ্রাম শহরে হলেও আসামি করা হয় কক্সবাজারের পেকুয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, রাউজান, চান্দনাইশসহ বিভিন্ন এলাকার মানুষজনকে। এর মধ্যে প্রবীণ শিক্ষক, লবণচাষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীও রয়েছেন। রয়েছেন বিএনপি নেতা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মীও। মামলার পর বাদীর নাম দিয়ে কয়েকজন আসামির কাছ থেকে চাঁদা দাবিরও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৬ জুলাই বেলা তিনটার দিকে ফাতেমা বেগমের ছেলে সাইফুল তাঁর বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করেন। কালা মিয়া বাজার থেকে মুরাদপুর মোড়ে এলে আসামিরা দলবদ্ধ হয়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর লোহার রড, দা, কিরিচ, হাতুড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আসামিদের হাতে বাঁশ, কাঠের লাঠি, ইট-পাথর, লোহার রড ও আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। হত্যার উদ্দেশ্যে ইট-পাটকেল, লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে মারধর, গুলিবর্ষণের ঘটনায় সাইফুলসহ অনেকেই গুরুতর আহত হয়ে রাস্তায় পড়ে থাকেন। লোহার রড ও হাতুড়ির আঘাতে সাইফুলের মাথা ফেটে যায়। বাম পা ও হাতে প্রচণ্ড জখম হয়। একজন রিকশাচালক সাইফুলকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান, সেখানে সাইফুলের মাথায় সেলাই দেওয়া হয়। চমেক হাসপাতালে রোগীর অতিরিক্ত চাপের কারণে পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য সাইফুলকে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর তাঁকে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান মা ফাতেমা বেগম। মামলায় উল্লেখ করা হয় সাইফুল দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। অথচ খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি দ্বিতীয় শ্রেণির পর আর পড়েননি। মামলায় ফাতেমার স্বাক্ষর থাকলেও তিনি নিরক্ষর বলে নিজেই জানিয়েছেন।
সরেজমিনে মহেশখালীর কালারমারছড়া ইউনিয়নের আঁধারঘোনা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা হয় ফাতেমা বেগম ও তাঁর আহত ছেলে সাইফুলের সঙ্গে। এ সময় গ্রামের অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
পাঁচলাইশ থানাতে মামলার কথা শুনে অবাক হন ফাতেমা বেগম। মামলা দূরের কথা গত কয়েক বছরে একবারও চট্টগ্রামে যাওয়া হয়নি দাবি করে ফাতেমা বেগম বলেন, তাঁর স্বামী রফিক উদ্দিনের আয়ে চলে তাঁদের টানাপোড়েনের সংসার। নদীতে স্বামী মাছ ধরতে না পারলে না খেয়ে থাকতে হয়। দুই মেয়ের বিয়ে হলেও এক ছেলে সাইফুল কয়েক মাস ধরে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক (টমটম) চালিয়ে সংসারে কিছু অর্থের জোগান দিচ্ছেন। টাকার অভাবে সাইফুলের পড়ালেখা হয়নি, দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল।
১২ বছর আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা মোহাম্মদ শাহ ঘোনার ফাতেমা বেগমের শ্বশুরবাড়ি বসতবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এরপর স্বামী ও তিন ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি আশ্রয় নেন বাপের বাড়ি আঁধার ঘোনাতে। মাটির দেয়াল ও টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট ঘর তুলে কয়েক বছর ধরে সেখানে থাকছে ফাতেমার পরিবার।
ফাতেমা বেগম বলেন, গত ১০ জুলাইয়ের দিকে সাইফুল রাজমিস্ত্রির কাজ করতে চট্টগ্রাম শহরে যান। ১৬ জুলাই বিকেলে রাজমিস্ত্রির কাজ শেষ করে ভাড়া বাসায় ফেরার পথে মুরাদপুর এলাকায় ছাত্রলীগ-পুলিশ ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের ত্রিমুখী সংঘর্ষে পড়ে যান তিনি। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। স্থানীয় কিছু লোক তাঁকে উদ্ধার করে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। তিন দিন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এরপর বাবা ও বড় বোন হাসপাতালে গিয়ে সাইফুলকে মহেশখালীতে নিয়ে আসেন। এরপর সাইফুল আর চট্টগ্রামে যাননি। ফাতেমা নিজেও গত ২০ বছর চট্টগ্রামে যাননি বলে দাবি করেন।
মায়ের পাশে বসে একই কথা বলেন সাইফুল। তিনি বলেন, পাঁচলাইশ থানায় গিয়ে তাঁর মা মামলা করবেন দূরের কথা, মহেশখালী থানায় যাতায়াতের সামর্থ্য তাঁদের নেই। কে বা কারা তাঁর মায়ের নাম ব্যবহার করে মামলা করেছেন—তার তদন্ত হওয়া দরকার।
সেখানে উপস্থিত ফাতেমার প্রতিবেশী কামরুল ইসলাম বলেন, সাইফুলের মা ফাতেমা বেগম নিরক্ষর। তিনি সই করতে জানেন না। একই কথা বলেন, কালারমারছড়া ইউনিয়নের আঁধার ঘোনা ৯ ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু আহমেদও। তিনি বলেন, ফাতেমা বাদী হয়ে মামলা করলে তাঁরা জানতেন। মামলার বিষয়ে এখন পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কেউ তাঁদের সঙ্গে কথা বলেননি।মামলার এজাহারে ফাতেমা বেগমের সই আছে। তবে ফাতেমা নিজেই জানান, তিনি নিরক্ষর।
#পূর্বশত্রুতার_জেরে_আসামি
পাঁচলাইশ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারে ১৭ নম্বর আসামি করা হয় কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার রাজাখালী ইউনিয়নের রকবত আলী পাড়ার অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষক নুর হোসেনকে (৫৮)। তাঁর প্রকৃত নাম নুর হোসেন সিকদার, বয়স ৬৭। তিনি বান্দরবানের আলীকদম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের দীর্ঘ ২০ বছর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৭ সালে অবসর নেন। এরপর তিনি পেকুয়ার নিজ বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করছেন। সম্প্রতি পেকুয়া থানার এএসআই মো. সামছুদ্দীন ভূঁইয়া মামলার তদন্তে গেলে বিষয়টি জানতে পারেন তিনি।
নুর হোসেন সিকদার বলেন, গত ছয়-সাত মাসের মধ্যে তিনি একবারও চট্টগ্রাম যাননি। বাদীকেও তিনি চেনেন না। তবে কিছুদিন আগে বাদীর নাম উল্লেখ করে একজন নারী তাঁর কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা পাঠানোর জন্য একটি বিকাশ নম্বরও দেন। অন্যথায় কারাগারে পাঠানোর হুমকি দেন। পৈতৃক সম্পত্তি নিয়ে ভাইদের সঙ্গে তাঁর মামলা আছে। তাঁদের কেউ মামলায় তাঁর নাম ঢুকিয়ে দিয়েছে বলে তাঁর সন্দেহ।
২২ নম্বর আসামি কুতুবদিয়ার উত্তর কৈয়ারবিলের তমিজ উদ্দিনে ছেলে সেলিম উদ্দিন (৩৫)। তাঁর প্রকৃত বয়স ৪৫। সেলিম বলেন, ২০২২ সালে কুতুবদিয়ার কয়েকজনের বিরুদ্ধে তিনি বাদী হয়ে চট্টগ্রাম সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেছিলেন। আসামিরা চট্টগ্রামের চকবাজার এলাকায় থাকেন। সুযোগ পেয়ে তাঁদের কেউ হত্যাপ্রচেষ্টা মামলাতে তাঁর নাম ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তিনি বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এবং এলাকায় থেকে লবণ ব্যবসা করছেন। বর্তমানে তিনি কুতুবদিয়া উপজেলা বিএনপির সদস্য এবং কৈয়ারবিল ইউনিয়ন বিএনপির অর্থ সম্পাদক।
কৈয়ারবিল ইউনিয়ন বিএনপি সভাপতি শফিউল আলম ও সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান বলেন, সেলিম উদ্দিন বিএনপির ত্যাগী একজন কর্মী। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন।
ফাতেমা বেগমের নামে মামলা নেওয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. সাজ্জাদ প্রথম আলোকে বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় এবং পরবর্তী অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে থানায় এসে অনেকে মামলা করেছেন। তখন তদন্ত করে মামলা রেকর্ড করার সুযোগ ছিল না। এখন সেসব মামলার তদন্ত চলছে। এজাহারে নিরপরাধ কাউকে যদি আসামি করা হয়, সে ক্ষেত্রে পরে বাদ দেওয়ার সুযোগ আছে।