Advertisement


মহেশখালীতে মিথ্যে মামলার শিকার সাংবাদিক পরিবার, নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বেরিয়ে শুনেন তিনি মামলার আসামি

# মসজিদে বসেও ১১ কি.মি দূরের মারামারির ঘটনায় আসামি হলেন ৭৬ বছর বয়সী বৃদ্ধা
# চেকের টাকা চাওয়ায় বাদিকে ম্যানেজ করে উলটো পাওনাদারকে মামলায় মিথ্যে আসামি!



বার্তা পরিবেশক।। ৭০ বছর বয়সী হারুন তাহের গত ১৯ জানুয়ারি দুপুরে মসজিদ থেকে নামাজ শেষ করে বেরিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন। দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে এক যুবক সামনে এসে জানালেন- আপনার বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়েছে। শুনে আকাশ ভেঙে পড়ার মতো হলেও নিয়তি হিসেবে মেনে নিলেন নীরবে৷ তিনি জানালেন- এ বয়সে লবণ মাঠ দখল করার মতো জঘন্য কাজ করবো কী করে? তাছাড়া যে ঘটনার মামলায় আমাকে আসামি করা হয়েছে সে ঘটনার সময় আমি ঘটনাস্থল থেকে আনুমানিক ১২ কিলোমিটার দূরে কালারমার ছড়ার মাইজপাড়া জামে মসজিদের আঙিনায় অবস্থান করছিলাম, যা আমার কল লিস্ট লোকেশন পর্যালোচনা করলে সত্যতা পাওয়া যাবে।

পেকুয়া মৌজায়  লবণ মাঠে সংগঠিত উক্ত ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি মামলায় আসামি করা হয় মহেশখালী কালারমার ছড়া ইউনিয়নের ইউনুছখালীর একই পরিবারের দুইজন নিরীহ ব্যবসায়ীকে। একজন ৭৬ বছর বয়সী অসুস্থ বৃদ্ধা ও অন্যজন ব্যবসায়িক ব্যক্তি মোস্তাফা কামাল। বৃদ্ধ হারুন তাহের দৈনিক পূর্বকোন এর কক্সবাজার জেলা প্রতিনিধি এরফান হোছাইন এর বাবা ও মোস্তাফা কামাল তার বড় ভাই। গত ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের পেকুয়া থানায় রুজু হওয়া একটি মামলায় তাদের আসামি করা হয়। যার মামলা নম্বর-১০। এ মামলাটি দায়ের করেন ওয়াজ উদ্দীন মাহমুদ নামে এক ব্যক্তি। যার মামলা নম্বর-১১।

হারুন তাহেরের বড় ছেলে এবং উপজেলা শ্রমিকদলের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও ফ্যাসিস্ট হাসিনার শাসনামলে নানারকম মামলা- হামলা ও  নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন ব্যবসায়ী মোস্তাফা কামাল। তার ব্যক্তিগত ব্যবহারের মুঠোফোনের কল লিস্ট ও লোকেশন পর্যালোচনা করে দেখা যায় ঘটনার সময় তাঁরও অবস্থান ছিল কালারমার ছড়ার ইউনুছখালী বাজারস্থ মোস্তফা কামালের ব্যবসায়ীক কার্যালয়ে। একই ঘটনায় পরদিন ২০ জানুয়ারি আরও একটি মামলা দায়ের করেন জসীম উদ্দীন সরকার নামে আরেক ব্যক্তি। ওই মামলায়ও তাদের আসামি করা হয়।

ভিন্ন তারিখে দুইটি মামলা হলেও ঘটনার সময় দেড় ঘণ্টার ব্যবধান যেটি একই এলাকা বলে উল্লেখ করা হয়। প্রথম মামলায় ঘটনার সময় হিসেবে উল্লেখ করা ৮ জানুয়ারি দুপুর ২ টা আর ২য় মামলা ১৮ জানুয়ারি দুপুর সাড়ে ৩টা। মামলায় পিতা ও ভাইকে আসামি করার বিষয়টি পূর্ব শত্রুতা ও পরিকল্পিত ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক হয়রানি বলে মনে করছেন সাংবাদিক এরফানের পরিবার। ইতোমধ্যে এর সুষ্ঠু তদন্ত চেয়ে ভুক্তভোগী পরিবারের পক্ষ থেকে জেলা পুলিশ সুপার, জেলা প্রশাসক, ডিআইজি ও আইজিপি বরাবর লিখিত আবেদন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।



মিথ্যা ভাবে মামলার আসামি নির্যাতিত বিএনপি নেতা মোস্তাফা কামাল জানান- মহেশখালীর আবুল হোসেন নামে এক ব্যক্তি হতে আমি ব্যবসা সূত্রে ২ লাখ টাকা পাওনা আছি, আমাকে একটি ব্যাংক চেকও দেন তিনি। কিন্তু ব্যাংকের একাউন্টে কোনো টাকা ছিলো না এবং সরাসরিও আমার পাওনা টাকা পরিশোধ করেননি, এ নিয়ে আমি আবুল হোসেনের কাছে উকিল নোটিশ পাঠাই এরপর থেকে তিনি আমি ও আমার পরিবারের উপর ক্ষেপে আছেন। পাওনা টাকা চাইলে তিনি আমাকে বিভিন্ন হামলা ও মামলার হুমকি দিয়ে আসছিলেন। আর পেকুয়া থানায় দায়ের হওয়া মামলার বাদীদের সাথে মহেশখালীর এই আবুল হোসেনের আত্মীয়তা রয়েছে, ফলে প্রতিশোধ পরায়ণ হয়ে আবুল হোসেন জসীম উদ্দীন ও ওয়াজ উদ্দীনকে দিয়ে তিনি ও তার পিতাকে মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে দিয়েছেন।

এ বিষয়ে সাংবাদিক এরফান জানান- কোনোরকম তদন্ত ছাড়া কাউকে আসামি করাও এক ধরনের অপরাধ। আমার পরিবার বিএনপিকে সমর্থন করায় বিগত হাসিনা সরকারের আমলে বিভিন্ন হামলা মামলার শিকার হয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শাসনামলেও কেনো যেন একই আচরণ দেখছি আমরা- তা বোধগম্য নয়। তদন্ত ছাড়া মামলা রুজু করা একটি ষড়যন্ত্র। পুলিশ প্রশাসনকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হলে আইন ও শৃঙ্খলা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

মিথ্যা মামলায় বৃদ্ধ হারুন তাহের ও তার পরিবারের হয়রানির ঘটনায় কক্সবাজারের কয়েকজন আইনজীবী ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, তদন্ত ছাড়াই মামলা রুজু করা দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থার লঙ্ঘন। এ বিষয়ে এডভোকেট মঞ্জুরুল হক বলেন, "একটি সুনির্দিষ্ট তদন্ত ছাড়া কাউকে মামলায় অভিযুক্ত করা শুধু বেআইনি নয়, এটি সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল। পুলিশ প্রশাসনের দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, কিন্তু এখানে দায়িত্বের পরিবর্তে কর্তৃত্ব পরায়ণ আচরণ লক্ষ্য করা গেছে।" এডভোকেট ফারহানা নাসরিন বলেন, "তদন্ত ছাড়া মামলা রুজু করা একটি প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনৈতিক স্বার্থে আইনের এ ধরনের অপব্যবহার বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হ্রাস হচ্ছে। একজন বৃদ্ধ ও তার পরিবারকে হয়রানি করার এই ঘটনা নিন্দনীয়।" এডভোকেট মাহবুব হোসেন বলেন, "আইনি পোশাক পরে বেআইনি কাজ করা শুধু নৈতিকতা বিরোধী নয় বরং এটি অপরাধ। মিথ্যা তথ্য দিয়ে ব্যক্তিগত শত্রুতার জেরে নিরীহ ব্যক্তিদের আসামি করার জন্য তদন্ত পূর্বক মামলার বাদি-সংবাদদাতাদের জবাবদিহিতা ও আইনের আওতায় আনা জরুরি।

"স্থানীয়রা শান্তিপ্রিয় বাসিন্দাদের অভিযোগ- পুলিশ রাজনৈতিক প্রভাবের কাছে নতিস্বীকার করে বা কোন ইন্ধন বা চাপের কারণে এ ধরনের মামলায় নিরীহ ব্যক্তিদের আসামি করা খুবই দুঃখজনক। এই ঘটনা সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে মামলায় আসামি হওয়া নিরীহ ব্যক্তিদের অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানান তারা। এ প্রসঙ্গে আইনজীবী স্বপন কান্তি বলেন, "আইনের শাসন তখনই প্রতিষ্ঠিত হবে, যখন পুলিশ প্রশাসন কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত ছাড়াই দায়িত্ব পালন করবেন। সুষ্ঠু তদন্তই কেবল এ ধরণে ঘটনার প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটন করতে পারে।"

জানতে চাইলে একটি মামলার বাদি ওয়াজেদ উদ্দিন জানান, আমি জমির মালিক, আমরা আমাদের প্রজেক্ট চাষ করতে চাইলে আমাদের উপর হামলা করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় আমরা মামলা করেছি। তবে তিনি হারুন তাহের ও মোস্তাফা কামাল নামে এই দুই ব্যক্তিকে চিনে না বলেও জানান। কিভাবে তাদের নাম মামলায় আসলো সে বিষয়ে মামলার এই বাদি কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি।

সরজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়- পেকুয়ার দুইটি মামলার বাদির সাথে কালারমার ছড়ার আফজালিয়া পাড়ার বাসিন্দা আমির হোসেন পরস্পর পরিচিত ও সুসম্পর্ক বিদ্যমান। আমির হোসেনের শশুরবাড়ি পেকুয়া হওয়ায় এতে তিনি সুযোগ বুঝে পাওনা টাকা না দেওয়ার কৌশল হিসেবে নিরাপদ ব্যক্তিদের মামলায় আসামি করা হয়। ঘটনার ভিড়িও চিত্র,  ছবি ও মোবাইল নম্বরের সিডিআর রিপোর্ট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- সেখানে এই ব্যক্তিদ্বয়ের সংশ্লিষ্টতা নাই। ঘটনা চলাকালে তাদের অবস্থান ছিলো প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে। এছাড়া উক্ত ঘটনায় উপস্থিত বহু প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে কৌশলে তথ্য নিয়ে জানা যায়- মোস্তাফা ও তার পিতা হারুন তাহেরকে ঘটনাস্থলে আমরা দেখিনি। এটি সুপরিকল্পিতভাবে হয়রানী করার জন্যে ওনাদের নাম দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা মৌলভী ফরিদ আহমেদ জানান, “মামলায় উল্লেখিত ঘটনার সময় আমরা মসজিদ প্রাঙ্গণে ছিলাম। কিন্তু কিভাবে ১২ কিলোমিটার দূরে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে একজন ৭৬ বয়সী অসুস্থ ব্যক্তি উক্ত মারামারি মামলায় আসামি হয়? তিনি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বলেন- আমরা এ কোন যুগে আছি?। প্রশাসন এমন নিরীহ ব্যক্তিদের আসামি হিসেবে দেওয়া মামলা কিভাবে গ্রহণ করে তাও ভাবার বিষয়।”
এ বিষয়ে পেকুয়া থানার ওসি সিরাজুল মোস্তাফা জানান, আসলে মামলার এজাহার আসার পর কে অপরাধী বা কে নিরপরাধ তা দেখার সময় থাকে না, দ্রুত মামলা না নিলেও আমরা বিতর্কিত হয়ে পড়ি। যদি নিরপরাধ ব্যক্তির ভুল নাম চলে আসে তা তদন্ত সাপেক্ষে বাদ দেওয়া হবে। মামলার চূড়ান্ত তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাওকে হয়রানী বা গ্রেফতার করা হবে না বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ মানবাধিকার ফোরামের কক্সবাজার জেলা সভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সেজান এহেসান জানান, এভাবে নির্দোষ ব্যক্তিদের মামলায় আনা মানে সেই মামলাটি হাল্কা হয়ে যাওয়া। পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তা সে বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে নিরপরাধ ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে দ্রুত আদালতে চার্জশিট প্রেরণ করা উচিত।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ জানান,  জেলায় দায়িত্বে যতদিন আছি আমার শতভাগ প্রচেষ্টা থাকবে কোন মামলায় নিরপরাধ কাওকে অযথা হয়রানি করা হবে না। তিনি ইতোমধ্যে বিষয়টি জানার পরে সংশ্লিষ্ট থানায় এ নিয়ে গুরুত্বের সাথে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বলে জানান।

এরফান হোছাইন//